শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
শেষ পর্ব

ঠিকানা

হাসনাত আবদুল হাই

ঠিকানা

বোঝা গেল মেয়ে লোকটি তার বউ। সে চলে গেলে আমি ইতস্তত করি। আমারও এখন চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি তার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। তার কথা না শুনে শুধু তার স্বামীর কথার উল্লেখ করে আমার প্রতিবেদন লেখা যাবে না...

আমি ফেসবুকে ছবিটার নিচে কমেন্ট করলাম : পেছনে ‘ঠিকানা’ কথাটা লেখা দেখতে পাচ্ছি। ঠিকানা কি ছবির সাবজেক্টের?

খোরশেদ আলম উত্তরে লেখেন : ছবি তোলার সময় সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাইনি। বাড়িতে আসার পর দেখেছি। যেখানে সাবজেক্ট দাঁড়িয়েছিল তার ঠিক পরে পেছনে ‘ঠিকানা’ কথাটি লেখা। কার ঠিকানা ছবিতে লেখা দেখে বোঝ যায়নি।

আমি লিখলাম : আহা! ওটা যদি সাবজেক্টের ঠিকানা হয় তা হলে আমি গিয়ে তার ইন্টারভিউ নিতাম। মনে হচ্ছে তার ওই দৃষ্টিতে

একটা কাহিনি রয়েছে। একটা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট লিখতে পারতাম আমার পত্রিকার জন্য।

খোরশেদ লিখলেন : আমি পরদিন হাঁটার সময় একই জায়গায় গিয়েছিলাম। বেশ কৌতূহল হয়েছিল তাকে আবার দেখার। তাকে পাইনি। যে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়েছিল সেখানে সব পোস্টার আর হাতে লেখা স্লোগান ইত্যাদি পড়ে দেখলাম। অনেক পোস্টারের পাশে ‘ঠিকানা’ কথাটা লেখা। এক সময় হয়তো ঠিকানার নিচে কিছু লেখা ছিল। এক পোস্টারের নিচে তা চাপা পড়ে গিয়েছে।

কিন্তু এটা বোঝা গেল সেখানে ছবির সাবজেক্টের ঠিকানা লেখা ছিল না। কী করে বুঝলেন?

আমার ইন্টুইশন বলল।

এরপর আমি আর কথা বাড়ালাম না। তিনি অল্প কথার মানুষ এটা জেনে গিয়েছি। ঠিক করলাম নিজেই যাব ইস্কাটন গার্ডেনের সেই জায়গায়, যেখানে সাবজেক্টকে খোরশেদ আলম দেখেছেন। হয়তো একই জায়গায় আমি তার দেখা পেতেও পারি অথবা স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করে জেনে যাব তার কথা, পেয়ে যেতেও পারি তার ঠিকানা। আমার কলাম ‘চেনা মুখ-অচেনা মুখ’ খুব জনপ্রিয় হয়েছে পাঠকের কাছে। খোরশেদ আলমের ছবি সাবজেক্ট আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে পেয়ে গেলে তার কথা আর ছবি দিয়ে যে প্রতিবেদন লিখব তা হতে পারে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে বেশ কয়েক বছর আগে যে আফগান মেয়েটির কভার স্টোরি করা হয়েছিল তার চেয়ে সেনসেশনাল। আমেরিকান সাংবাদিক প্রায় বিশ বছর পর গিয়ে তাকে খুঁজে বের করেছিল। আমি কেন এক দিন পর তাকে খুঁজে পাব না?

আগামীকালই ইস্কাটন গার্ডেনে গিয়ে সাবজেক্টের খোঁজ করব আমি, কেউ না কেউ তাকে নিশ্চয় চেনে, যদি সে সেখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। সেখানেই কোথাও থাকে সে, দূর থেকে আসে, এমন মনে করার কারণ থাকতে পারে না। তার অবস্থা এমন না যে সে এক এক দিন এক এক জায়গায় গিয়ে থাকবে। দরকার হলে আমি ঘোরাঘুরি করব সেখানে, কেউ না কেউ তাকে চিনবে। অমন চেহারার একটা মানুষকে মনে রাখার কথা, যেমন ২০ বছরেও ভোলেনি আমেরিকান সাংবাদিক আফগান সেই নারীকে তার চোখের চাউনির জন্য।

৪.

বাস থেকে নামতেই বাঁ দিকে চোখে পড়ল দৃশ্যটা। মনে হলো যেন দুশো মাইল বেগে একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছে জায়গাটার ওপর। একটা গ্রাম ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে যেন অসুর কোনো শক্তি। গ্রামটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে তার সমস্ত সীমানা নিয়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ঘরবাড়ি। এখানে এক সময় গাছপালা ছিল তা শুধু কয়েকটা বাঁশঝাড়ের ভগ্নাংশ আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ দেখে বোঝা যায়। তালগাছের পাতা থেকে ঝুলছে বাবুইয়ের বাসা মৃদুমন্দ বাতাসে। মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে একটু পর পর। ফসলের খেতে ট্রাক্টর চলছে, পাশেই দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে কাটারপিলার। অনেক মজুর ব্যস্ত হয়ে ভিটে থেকে ভেঙে ফেলা মাটি মাথায় করে নিয়ে ফেলছে একটা নিচু জায়গায়। গ্রামটা নেই, কিন্তু চারিদিকে ব্যস্ততার ছবি, টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। হুকুম দেওয়ার শব্দ, ধমকের গর্জন। শুধু এক জায়গায় গ্রামটা রয়ে গিয়েছে আগের মতো। কবরস্থানের ভেতর ঝোপ-জঙ্গল উঁকি দিয়ে দেখছে ভেঙে পড়া দেয়ালের ফাঁক দিয়ে। সেখানে কয়েকটা মাঝারি গাছ থেকে ফল ঝুলছে, মনে হয় ডালিম। মাঝে মাঝে পুকুর চোখে পড়ল কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে। কয়েকটার পারে শিমুল গাছ যেন ঝিমুচ্ছে অথবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পুকুরের দাম আর শ্যাওলা ভর্তি পানির দিকে। কয়েকটা কাক উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে।

আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ল অন্য ধরনের ব্যস্ততা। গ্রামের মানুষ সংসারের জিনিসপত্র ওঠাচ্ছে ঠেলাগাড়িতে, কেউ কেউ পুরনো হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি বোঝা তুলে নিচ্ছে মাথায়। কেউ কেউ টেনে নামাচ্ছে ঘরের চালা, বাঁশের তর্জার বেড়া, উইপোকায় কাটা খুঁটি। বেশির ভাগ বাড়িই বিরান দেখাছে, কিছু অবশিষ্ট নেই দাঁড়িয়ে থাকার মতো। কেউ বা কোনো পরিবার বাস করত শূন্য পরিত্যক্ত ভিটের ওপর, এমন মনে করিয়ে দেবার মতো পড়ে আছে ভাঙা কলসির টুকরো, দরমার ছেঁড়া চাটাই, লাল গামছার ছেঁড়া ফালিখড়ের গাদার নিচে শুকনো খড়ের ওড়াউড়ি। অধিকাংশ বাড়িই জনশূন্য, শুধু কয়েকটি খাঁ খাঁ করতে থাকা ভিটের পাশে, উঠানে দেখা যাচ্ছে মেয়ে, পুরুষ ব্যস্ত হয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে সংসারের মলিন জিনিসপত্র। তারা গ্রাম ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। নামেই শুধু গ্রামটা আছে, তার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই, বোঝা যায় না এখানে কোনো দিন মানুষের বসতি ছিল।

আমি অনেকগুলো পরিত্যক্ত ভিটে পেরিয়ে এক কৃষকের বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। বাড়ির কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। সব ভেঙে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দুটো রংচটা তোরঙ্গ আর কয়েকটা বস্তায় তৈজসপত্র ভরেছে এই কৃষক পরিবার। এখন চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো নিয়ে যাচ্ছে যা কিছু তাদের কাছে মূল্যবান। উঠোনের পাশে শজনে গাছে বসে কর্কশ স্বরে ডাকছে কয়েকটা কাক। পাশে দুটো কলাগাছ হেলে দাঁড়িয়ে, পাতাগুলো কেটে নেওয়ায় ন্যাড়া দেখাচ্ছে। কেটে নেওয়া বাঁশঝাড়ের গুঁড়িগুলো চকচক করছে রোদে। একটা বেজি দৌড়ে পালাল গুঁড়িগুলোর পাশ দিয়ে, মনে হলো ঝোপ খুঁজছে। সারা উঠোনে শুকনো বাঁশপাতা উড়ছে বাতাস এলে।

আমি রাস্তা থেকে একটু হেঁটে কৃষকের ভিটের সামনে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াই। কৃষক ব্যস্ত হয়ে রশি দিয়ে বস্তার মুখ বাঁধছিল। আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, কাজ বন্ধ না করে। তার চোখে কৌতূহল নেই। উঠোনের মাঝখানে বসে থাকা ঘোমটা ঢাকা মেয়েলোক মনে হয় তার বউ। সে ঘোমটা বড় করে ঘুরে বসল। তার কাছে ময়লা রংচটা কাপড়ের ফ্রক পরা সাত-আট বছরের মেয়েটার হাতে একটা খাঁচা, ভেতরে ময়না পাখি চঞ্চল হয়ে দাঁড়ের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে।

আমি কৃষকের উদ্দেশে বলি, ভাই কিছু কথা বলা যাবে?

কৃষক যেমন কাজ করছিল সেভাবেই নুইয়ে থেকে বলল, কী কথা কন। টাইম নাই। দেখেন না কত কাম হাতে। তার স্বর বেশ রুক্ষ।

আমি গলা পরিষ্কার করে বলি, এই আপনাদের যাওয়া নিয়ে।

লোকটা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, কন হুনি। টাইম নাই। অহন না গেলে গাড়ি আইনা সব গুঁড়াইয়া দিব, কইয়া গেছে।

আমি বলি, দেখা যাচ্ছে গ্রামের প্রায় সবাই চলে গিয়েছে। আপনারা কয়েক ঘর ছাড়া।

কোথায় গেল তারা?

যে যেমুন পারে গ্যাছে গিয়া। না গিয়া করব কী?

আমি ইতস্তত করে বলি, আপনিও চলে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন ভাই?

সে আগের মতোই মাথা নিচু করে কাজের মধ্যে হাসল। তারপর বলল, শ্বশুরবাড়ি।

শুনে আমি বেশ ধন্ধে পড়লাম। সে কি সত্যি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, না রসিকতা করে বলল কথাটা? আমি কিছু বলার আগে সে নিজেই বলল, মজা কইরা কইলাম। শ্বশুরবাড়ি গিয়া থাকুম কেমনে? তারা নিজেরাই কুনো মতো আছে।

তাহলে কোথায় যাচ্ছেন? সরকার কি অন্য কোথাও জমি দিয়েছে?

এবার সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, কী কইলেন? জমি দিছে? হাসির কথা কইলেন দেহি। সরকার জমি দিব ক্যান?

আমি বললাম, তা হলে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে নিশ্চয়। দেয়নি?

কাঁধে ঝোলানো গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে বলল, দিছে। সব না, কিছু দিচ্ছে, বাকিটা?

লোকটা মুখ থেকে একদলা থুতু বের করে ফেলে দিয়ে বলে, পরে দিব। পরে কবে তা কয় নাই। তাগো অফিসে যাওন লাগব।

আমি বললাম, যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে নতুন ভিটেবাড়ি, চাষবাসের জমি কেনা যাবে?

নাহ। ভিটার জায়গা কিনতেই ট্যাহা শেষ। চাষবাসের জমি কিনুম ক্যামনে?

তাহলে কীভাবে সংসার চলবে? খাওয়া, কাপড় পরা- এই সব খরচ মেটাবেন কী করে?

অন্যের খেত-খামারে কাম করুম। তারপর হেসে বলে, ছিলাম চাষি, হইবাম মজুর। মন্দ কী? দুবেলা খাওন জুটলেই হইল। বলে সে পরিত্যক্ত ভিটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

আমি বলি, এখান দিয়ে মস্ত বড় সড়ক যাবে রাজধানীর দিকে। সেটা হলে আপনাদের ভালো হবে, তাই না?

কেমুন ভালা হইব? কন শুনি। তার স্বরে ব্যঙ্গ।

এই ধরেন গ্রামের শাক-সবজি তরিতরকারি, এই সব ঢাকায় নিয়ে বেচতে পারবে গ্রামের মানুষ। বলে আমি বুঝতে পারি এ কথা বলা ঠিক হলো না। আমার অনুমান নির্ভুল প্রমাণ করে লোকটা অবাক হয়ে বলল, কুন গ্রাম? গ্রাম দেখলেন কই আপনে?

আমি শুধরে নিয়ে বলি, আশপাশের গ্রামের কথা বলছিলাম।

লোকটা মাথার ওপর বস্তা তুলতে তুলতে বলল, হ্যাতে আমার কী লাভ হইব? খুব মজার কথা কইলেন। যাই এহন, গরুরগাড়িতে বস্তা রাখতে যাই। বলে সে উঠানে বসে থাকা মেয়েলোকটিকে বলে, রাবুর মা, অপেক্ষা কর। আমি মালটা রাইখা আইতাছি।

বোঝা গেল মেয়েলোকটি তার বউ। সে চলে গেলে আমি ইতস্তত করি। আমারও এখন চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি তার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। তার কথা না শুনে শুধু তার স্বামীর কথার উল্লেখ করে আমার প্রতিবেদন লেখা যাবে না। লিখলে তা হবে অসম্পূর্ণ। এইভাবে আরও দু-তিনটি কৃষক পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারলে মোটামুটি প্রতিনিধিত্ব করে, এমন একটা রিপোর্ট লেখা যাবে। আমি মরিয়া হয়ে আমার রেকর্ডার নিয়ে মা আর মেয়ের কাছে যাই। প্রথমে কথা বলি মেয়েটির সঙ্গে। হেসে বলি, তোমার নাম বুঝি রাবু? বেশ সুন্দর নাম। তারপর খাঁচা দেখিয়ে বলি, তোমার পোষা ময়না কি কথা বলতে পারে?

রাবু জড়োসড়ো হয়ে বলে, শিখতাছে।

আমি বলি, ও নতুন তাহলে। হ্যাঁ, একটু সময় নিবে কথা বলতে।

রাবু বলে, আমার নাম কইতে পারে। রাবু।

সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার ভেতর থেকে পাখিটা ডেকে উঠল, রাবু। শুনে রাবুর মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। এতক্ষণ তাকে মনমরা দেখাচ্ছিল। সারাক্ষণ মাটির দিকে মুখ নিচু করে ছিল। আমি এবার তার মাকে প্রশ্ন করার জন্য মুখ ফিরিয়ে নিই। দেখে রাবুর মা আরও জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। এই সময় হঠাৎ একটা দমকা বাতাস আসে, ধুলো উড়িয়ে, শুকনো পাতার ঘূর্ণিঝড় তুলে। আমি চোখ ঢাকতে চেষ্টা করি ধুলো থেকে রক্ষা পেতে। সেই সময়, ওই মুহূর্তে রাবুর মায়ের মাথা থেকে ঘুমটা সরে যায়। আমি তার চেহারা দেখতে পাই। দেখে চমকে উঠি। একটা মিল দেখতে পাই, যেন ছবিটা হঠাৎ পেছনে চলে গিয়েছে। ফাস্ট ফরোয়ার্ড। ছবিটা আমার সামনে এসে যায়। মাঝখানে একটা মুহূর্ত শুধু।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর