গল্প
তখন রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, সরকারি আদেশ মতো।
সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান ৮টায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবাই চলে যাওয়ার সহযোগিতা করছে। কাল মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ।
রাত সাড়ে ৮টা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটম টিপে ঘুরে দাঁড়ালো। দেখলো লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা, এক যুবতী।
লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেলো। অন্ধকার হলো লিফট। মেয়েটি আঁতকে উঠে ঘুরে তাকালো
: কী হলো?
অস্ফুট স্বরে আশিক বললো
: কারেন্ট চলে গেলো।
: লোডশেডিং!
: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।
সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করলো। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক ও এক রক্ষণশীল নারী।
আশিক তার মুখের মাস্ক খুলে, মোবাইল লাইট অন করলো। বেশ আলোকিত হলো লিফট। মেয়েটি দু’চোখে ভয়ার্ত আতঙ্কে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। আশিক বুঝতে পারলো, মেয়েটি শঙ্কিত, ভীত সন্ত্রস্ত। যেনো তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকার বন্দিশালায়। আশিক লিফট ইন্টারকমের বাটম টিপলো।
: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।
আশিক ইনটারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। সিকিউরিটি রমিজ শপিং মলের আন্ডার গ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে,
: কে আছেন লিফটের দরজা খোলেন আমরা আটকা পড়েছি।
সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত আঘাত করছে আর বলছে।
: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছেন, জেনারেটর চালু করেন। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলবো। ভেঙেই ফেলবো।
আশিকের এই ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছলো। দ্রুত সিকিউরিটি পারসন লিফট ইন্টারকম বাটম টিপে বলেন-
স্যার, স্যার আমি মার্কেট সিকিউরিটির রমিজ।
: আপনাদের লিফটম্যানকে বলেন জেনারেটর চালু করতে।
: স্যার লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।
: তাহলে আপনিই তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করার ব্যবস্থা করেন।
: কেমনে চালু করুম স্যার সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।
: লিফটের চাবি নিয়ে, আপনি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দু’জনকে বের করেন।
: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে, লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দিই।
আপনার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলেন।
: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।
আশিক লক্ষ্য করলো মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক নিজের মনেই বললো,
: উহ্! এই গরমে টিকবো কী করে?
মেয়েটি আঁতকে উঠলো
: এ্যাঁ! তবে?
লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠলো। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকালো লিফট সাউন্ড বক্সের দিকে।
: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছেন তো?
সিকিউরিটি রমিজ বললেন-
: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।
আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-হোয়াট!
শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠলো
হে আল্লাহ, এখন উপায়!
রমিজ মিয়া বললেন,
আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তারপরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।
আশিকের মোবাইল আলোয় কী অ™ু¢ত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার! লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দু’জন অচেনা-অজানা যুবক, যুবনারী।
এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতকক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে বসে পড়লো। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিলো। আশিক লক্ষ্য করলো মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্য প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাত পাখা করে বাতাস নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝুলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো। মেয়েটি হাত বাড়িয়েও কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিলো। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কর্ক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিলো। মেয়েটির মনে যেনো একটা বিশ্বাসের আভাস ফুটে উঠলো অজানা যুবকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠলো আশিকের হাতের আঙুল ফেটে রক্ত ঝরে পড়া দেখে। মেয়েটি পানির বোতলটা লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে, আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে বিনয়ের সুরে বলে-
: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।
মেয়েটি বোতল তুলে ঢক ঢক করে পানি পান করে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিলো। আশিক এক অনন্যা সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেনো আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিলো। মেয়েটিকে বললো
: আমি আশিক। আপনি?
: নাজমা!
: তো-এতো প্যাকেট, কী শপিং করলেন?
: গায়ে হলুদের কিছু সামগ্রী।
: ও! আপনার গায়ে হলুদ?
: জ্বি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদ সন্ধ্যা।
: তো- সাথে কেউ আসেনি?
: বাবা নেই। মা বৃদ্ধা। বেশি হাঁটাচলার ঝুঁকি নিতে পারেন না।
: সূচনা?
: সামান্য ক’টা আইটেম, ভাবলাম একাই পারবো।
: আপনার হাসবেন্ড?
: জি!
নাজমা আঁতকে উঠলো। আশিক বললো
: চমকে উঠলেন যে!
: এমনি।
: না বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে আপনার হাসবেন্ডকে নিয়ে-
: নেই।
: নেই, মানে ছোটবোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...
: বিয়ে, ঘর সংসার এসব নিয়ে আর ভাবছি না।
: কেন?
: ব্যাপারটা কোথায় যেনো একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাসবেন্ড
ছিলো।
: তো এখন উনি-
আশিক লক্ষ্য করলো, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেনো জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকোবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে নাজমা। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠলো। রিসিভ করলো।
: হ্যালো মা। এই তো একটা জায়গায়। কারেন্ট আসলেই চলে আসবো। জি। জি মা।
আশিক মোবাইল বন্ধ করলো।
: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।
: চার্জ নেই।
: আমার আবার ব্যালেন্স নেই। নইলে এটা দিয়ে বাসায় ম্যাসেজ দিতে পারতেন। একটা ইমারজেন্সি ব্যালেন্স নেবো, সেটাও ভার্সিটিতে নেওয়া হয়ে গেছে দুপুরে।
মার্কেটে একটা জরুরি কিছু কিনতে এসে আটকে গেলাম।
নাজমা ঘড়ি দেখছে বারবার আর বোর্ড পেপার দিয়ে বাতাস করছে। লিফটের ইন্টারকম বক্স থেকে সিকিউরিটি রমিজ মিয়ার কণ্ঠ ভেসে আসলো
: স্যার, বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করছিলাম। বললো এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কারেন্ট আসবে। আর মাত্র পনেরো বিশ-মিনিট ধৈর্য ধইরা ম্যাম সাবরে লইয়া অপেক্ষা করেন স্যার।
: আচ্ছা, আপনি কিন্তু লিফটের কাছেই থাকবেন।
: জি স্যার।
নাজমা চুপচাপ বসেছিলো। আশিক আবার আলাপের মধ্যে নাজমার এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মনটা একটু আলাদা করতে চেষ্টা করছে।
: ও হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আপত্তি যদি না থাকে, তাহলে আপনার জীবনের গল্পটা।
: আমার জীবনের কোনো গল্প নেই।
: নেই। তবু ছিলো।
: রাহাত ছিলো বাবার বন্ধুর ছেলে। আমি লালমাটিয়া ওমেনস কলেজ থেকে দু’বছর আগে এইচএসসি পাস করেছি। বাবা বললেন বিয়ে করো। ছেলে ঠিক। স্বামীর ঘরে থেকেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না।
: তারপর?
: রাহাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। ধানমন্ডির বড় লোক স্বামীর ঘর সংসার পেলাম। কিন্তু
: কিন্তু?
: রাহাত বিয়ের দিন থেকেই পৃথক পালঙ্কে আমাকে রেখে ওর স্বপ্নের সাথীর সঙ্গে কথা বলতো। আমাকে বুঝাতো, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার জীবনে আসতে বাধ্য হয়েছে। রাহাতের জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। ব্যবসায় মন বসতো না। রাত করে বাড়ি ফিরতো।
নাজমা ডান হাত দিয়ে চোখ মুছলো।
আশিক বললো
: আচ্ছা, পরিবারের অভিভাবক কেউ কি জানতেন না-রাহাতের জীবনে একটা নিজের স্বপ্ন ছিলো।
: না। জানতেন না।
: কিন্তু রাহাতের তো বলা উচিত ছিলো, সবাইকে তার স্বপ্নের কথা। এটা তো খুবই জরুরি দায়িত্ব ছিল।
: উচিত ছিলো। বিশ্বাস করুন দুটি মাস রাহাতের অবজ্ঞা-অবহেলা সব সহ্য করে ওকে একটি কথাই বুঝাতে চেয়েছি, যেখানে ভালোবাসা নেই, সুখ নেই, সেই প্রাচুর্য পালঙ্কে শুয়ে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।-
নাজমা আবার চোখ মুছলো। আশিক বললো
: তারপর, তারপর কী হলো?
: আমি চাইনি ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র সন্তান রাহাত চৌধুরীর দাম্পত্য কলহে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক। আর মিডিয়ার লোক এই সুযোগ নিয়ে সারা দেশে একটা নোংরা নিউজ ভাইরাল করে ওই পরিবার আর আমার বাবাকে বিব্রত অসম্মানিত করার সুযোগ পাক।
রাহাতের ইচ্ছে, সবার সম্মতি নিয়ে দুই পরিবার সমঝোতা করে রাহাতের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেলো।
বিস্মিত আশিক বললো
: ডিভোর্স?
: একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিলাম গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম। সূচনাকে এইচএসসি পাস করিয়ে ওর পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করলাম।
: Lovely sister.
: ভাবছি, সূচনাকে বিয়ে দিয়ে বিদেশে চলে যাবো।
আশিক এবার একটু বিনম্র সান্ত্বনার কণ্ঠে বললেন-
: দেখুন নাজমা, সমুদ্রে অনেক ঢেউ ওঠে, তীরে এসে মিলে যায়। তারপরও ঢেউ আসে।
: প্রকৃতির মতো সব জীবন তো আর এক হয় না। এই যে লিফটের চার দেয়ালের অন্ধকারে বন্দি হয়ে আছি। বিদ্যুৎ এলেই বেরিয়ে যাবো। কিন্তু মানুষের জীবনে কখনো এমন কঠিন পরিস্থিতি আসে, যার চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে যাওয়া বড় কঠিন। নির্মম কঠিন।
নাজমা এবার সশব্দে কেঁদে ফেলল।
সহসা বিদ্যুৎ চলে আসলো।
আশিক উঠে দাঁড়ালো।
উঠুন নাজমা। আলো চলে এসেছে।
নাজমা উঠে প্যাকেটগুলো হাতে তুলে নিলে গ্রাউন্ড ফ্লোর বাটম চাপ দিলো আশিক।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে লিফটের দরজা খুলে যেতেই আশিক নাজমা বেরিয়ে আসলো। লিফটম্যান রমিজ ছুটে সামনে এসে বললেন
: স্যার, আপনারা ঠিক আছেন তো?
ক্ষিপ্ত আশিক মেজাজ হারিয়ে লিফটম্যানের প্রতি ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। তাকে নিবৃত্ত করেন সিকিউরিটির লোকটি। এর মধ্যে উৎসুক জনতার একটা জটলা জমে ওঠে।
জটলা ঠেলে বেরিয়ে এসে আশিক ঘুরে নাজমাকে খুঁজলো।
আশপাশে কোথাও সে নেই।
আশিক তার হাতে পেঁচানো সাদা নেকাবটা এক নজর দেখে শপিং মল থেকে দ্রুত বেরিয়ে বাইরে এসে নাজমাকে চারদিকে খুঁজলো। না, নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশিক। এক ঘণ্টার সহবন্দি তরুণীর ঐন্দ্রজালিক অন্ধকারের কাব্যময় স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলো আশিকের বিষণ্ন চোখে।