অনুগল্প
ঢাকার আকাশ আজ কেঁদেই চলেছে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই অন্ধকার নেমে এসেছে গাঢ় মেঘের চাদরে। রাস্তায় জল থইথই। গলির মোড়ে থেমে থাকা সিএনজি, রিকশা আর কাকভেজা পথচারীদের দেখে বোঝা যাচ্ছে-আজকের দিনটা সাধারণ কোনো দিন নয়।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ধারার দিকে তাকিয়ে আছি। অবিশ্রান্ত এক জলের ধারা জানালার কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আর আমার চোখ বেয়ে নামছে এক অদৃশ্য অতীত- ভেজা কোনো দিনে জমে থাকা স্মৃতির জলধারা।
ঠিক এমন এক দিনে, বহু বছর আগে, একটা কদমফুলের গুচ্ছ হাতে দিয়েছিল এক মেয়ে। নামটা আজ আর বলতে চাই না। আজও ঠিকঠাক মনে আছে, তবু বলা হয়ে ওঠে না। সে যেন কোনো এক বর্ষার ঘোর লাগা দুপুরের স্বপ্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তখন টিপটিপ বৃষ্টি। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই পুরোনো পুকুরঘাটে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল-
“তুমি জানো, কদমফুল আমি কত ভালোবাসি? এটা শুধু ফুল না। বর্ষার চিঠি।”
আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, “তাহলে আমি হই সেই ডাকপিয়ন, যে প্রতি বর্ষায় তোমার হাতে কদমফুল পৌঁছে দেবে।”
সে একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “না রে পাগল, আমি-ই বরং কদমফুল হয়ে তোর বুকে ঝরে পড়তে চাই।”
সে কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। এই ঝুম বৃষ্টির শব্দে যেন আবার ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর।
তারপর হঠাৎ করেই সবকিছু থমকে গিয়েছিল। এক বর্ষাতেই।
তার বাবার শরীর খারাপ। চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা। আর আমি পেয়েছিলাম একটি চিঠি। হাতে লেখা, কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা-
“আমার আর ফেরা হবে না। তোমার জীবনে যেন কোনো কালো মেঘ না নামে, সেই জন্যই দূরে যাচ্ছি। আমাকে ভুলে যেও... যদি পারো।”
চিঠির ভাঁজে রাখা ছিল একটি শুকনো কদমফুল। তখন যে কদমফুল আমার হাতে তুলে দিয়েছিল সে-আজ তা আমার বুকের এক কোণে শুকিয়ে আছে। তবুও তার গন্ধ হারিয়ে যায়নি।
আজ এই বর্ষার দিনে, বারান্দার কোনায় বসে সেই চিঠিটা আবার পড়ছি। কত বছর কেটে গেছে। সময় থেমে থাকেনি। তবু সেই অক্ষরগুলো আজও ভিজে থাকে। বারান্দায় জমে থাকা জলরাশিতে একগুচ্ছ কদমফুলের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে-জানি, তা বাস্তব নয়, স্মৃতিরই প্রতিচ্ছবি।
সে কোথায় আছে এখন, আমি জানি না। হয়তো দূরের কোনো শহরে, অন্য এক জীবনে, অন্য এক ঘরে। কিন্তু আমার জীবনে, প্রতি বর্ষায় কদমফুল ফিরে আসে-তার গন্ধে, তার রঙে, তার নরম পাপড়িতে।
প্রতি বর্ষায় আমি নিজেই একগুচ্ছ কদমফুল গেঁথে রাখি জানালার ধারে। মনে করি, এই ফুল হয়তো এক দিন পৌঁছাবে তার কাছে-হয়তো কোনো স্বপ্নে, হয়তো কোনো নীরব বার্তায়।
আজও জানালার পাশে বসে আমি তার জন্য রেখে দিলাম একগুচ্ছ কদমফুল।
আর বৃষ্টির শব্দে আবার যেন শুনতে পেলাম সেই কথাটি-
“আমিই কদমফুল হয়ে তোর বুকে ঝরে পড়তে চাই!”