শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই কুমির খামার এখন...

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

সেই কুমির খামার এখন...

প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের ঋণের বোঝায় জর্জরিত ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামে অবস্থিত দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। খেলাপি ঋণ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে পি কে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলে সংকটে পড়ে কুমির খামারটি। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত নানামুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে কোনোমতে টিকে থাকে খামারটি।

অথচ ওই সময়ে রপ্তানিযোগ্য কুমিরের চামড়া ছিল প্রায় ১ হাজার ১০০। যা থেকে আয় করা যেত ৫ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। রপ্তানি তো সম্ভবই হয়নি, উল্টো খাবার কষ্টে প্রাণ হারায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ কুমির। বেঁচে থাকা ১ হাজার ৭০০ কুমিরের মধ্যে বেশির ভাগই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। একই সময়ে ডিম ফুটে প্রায় আড়াই হাজার কুমিরের বাচ্চাও পাওয়ার কথা ছিল ফার্মটির। অবকাঠামোগতভাবেও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় প্রতিষ্ঠানটি। ওই দীর্ঘ সময়ে বেতন-ভাতাও বন্ধ থাকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে ৬ সদস্যের পরিচালনা কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। এই পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাণ ফিরতে শুরু করে খামারটিতে। নতুন করে জীবন পায় ১ হাজার ৭০০ কুমির। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা এসব কুমিরের ডিম থেকে ৯০০-এর অধিক বাচ্চাও পাওয়া যায়। আর সামনের বছরে ২ হাজার বাচ্চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বলে জানান খামারটির ব্যবস্থাপক ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ।

তিনি আরও জানান, ‘আশা করছি এ বছরের শেষনাগাদ দেড় কোটি টাকার বেশি চামড়া রপ্তানি সম্ভব হবে। আগামী বছর এর পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে।’

এদিকে সম্প্রতি সরেজমিন ২৫ একরের বাণিজ্যিক এই খামারটিতে গিয়ে অনেক পরিবর্তনের দেখা মেলে। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কুমিরের জন্য নতুন করে চারটি পুকুর তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি পুকুরেই রাখা হয়েছে বিভিন্ন আকারের কুমির। নির্মাণ করা হচ্ছে ক্যান্টিন ও হল রুম। যার ধারণ ক্ষমতা ৫০০ থেকে ৬০০। শিশুদের বিনোদনের জন্য তৈরি হচ্ছে শিশুপার্কও। নির্মাণের পাইপলাইনে আছে কুমির রিসার্চ সেন্টার ও মিউজিয়াম।

এমন কাঠামো গড়ে তোলার কারণ জানতে চাইলে খামার পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুমির বিশেষজ্ঞ এনাম হক বলেন, ‘পর্যটন আকর্ষণ উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে খামারটিকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৫০ টাকা এবং শিশু ও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা। পর্যটন ও কুমিরের চামড়া রপ্তানির আয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটিয়ে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে ব্যাংক ঋণ শোধ করা হবে।’ জানা যায়, নতুন এই পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর খামারটিকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি লাভজনক খাতে রূপান্তরের জন্য উচ্চ আদালতে নানা সংকট তুলে ধরা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডকে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার কিছু বেশি ঋণ দেয়। এরই মধ্যে ঋণের ৩৫ শতাংশ ছাড় হয়েছে। আর এই টাকা দিয়েই খামারটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে বলে জানানো হয়।

খামারটির স্বাধীন পরিচালক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম বলেন, ‘কিছুদিন আগেও মৃতপ্রায় শিল্পটিকে আবারও সম্ভাবনাময় করে তোলার চেষ্টা করছি আমরা। সেজন্য আমাদের দুই থেকে তিন বছর সময় প্রয়োজন। তবে এ ধরনের অপ্রচলিত সম্ভাবনাময় রপ্তানিযোগ্য শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন দক্ষ উদ্যোক্তার।’

বর্তমান পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. নাইম আহমেদ মনে করেন, একটি কুমিরের মাংসসহ উপজাত দ্রব্য (হাড়, দাঁত, মাথার খুলি) থেকে চামড়ার সমমূল্যের টাকা আয় করা সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে বন বিভাগের নমনীয় হতে হবে। উপজাত দ্রব্য রপ্তানি ও দেশীয় বাজারে বিক্রির অনুমতি দিতে হবে। ইতোমধ্যে অনুমোদন চেয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি।

সম্ভাবনার কথা : সাধারণত ছোট প্রকল্পগুলো থাইল্যান্ডসহ আশপাশের দেশগুলোতে রপ্তানি করতে পারলেও জাপানে চামড়া রপ্তানি রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। কারণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার হলো জাপান। আর এই চ্যালেঞ্জকে জয় করে প্রতিবছরই জাপানের চামড়া আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চামড়া কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরি সহায়তা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা পেলে বাংলাদেশের কুমিরের নানান অংশ রপ্তানি করে মালয়েশিয়া, জাপান, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি উন্নত দেশের বাজার দখল করা এখন সময়ের ব্যাপার। চামড়া ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে কুমিরের দাঁত, হাড় ও মাথার খুলির। এসব দিয়ে তৈরি পণ্য জাপান, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চড়া দামে বিক্রিও হচ্ছে।  আবার ৭০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যমানের কুমিরের মাংসের চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ফলে দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা এ খামারের মাধ্যমে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতছানি দিচ্ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক অবস্থায় কারাগারে মারা যাওয়া মুশতাক আহমেদ ছিলেন দেশের প্রথম কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম অংশীদার। কিন্তু নানান কূটকৌশলে মুশতাককে সরিয়ে খামারটি বাগিয়ে নেন পি কে হালদার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর