দেশের হকির কিংবদন্তি তাকেই বলা হয়। আবদুস সাদেক। ক্রীড়াঙ্গনে যার পরিচয় হকির লোক বলেই। বর্তমানে তিনি হকি ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি। সত্তর দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের হয়ে বেশ কয়টি ম্যাচ খেলেন। হকিতে সাদেক কতটা উঁচুমানের খেলোয়াড় ছিলেন প্রমাণ মেলে ঢাকা সফরে এসে আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনের সভাপতি নেগ্রের মুখে তার পারফরম্যান্সের প্রশংসা শুনে। বয়স হলেও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হকির প্রয়োজনীয় কাজে এখনো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। অথচ ১৯৭২ সালে ফুটবল লিগে দেশের জনপ্রিয় দল ঢাকা আবাহনীর অভিষেক ঘটেছিল সাদেকের নেতৃত্বেই। নতুন দল হলেও শুরুতেই আবাহনী সেরা দল গড়তে সক্ষম হয়েছিল। যোগ দিয়েছিলেন গোলাম সারওয়ার টিপু, কাজী সালাউদ্দিন, অমলেশ সেন, আশরাফ, আলী ইমাম, দিপু ও গফুর (ঢাকা মাঠে যিনি স্কুটার নামে পরিচিত ছিলেন)। মাঠ কাঁপানো এতসব ফুটবলার থাকার পরও কীভাবে সাদেক আবাহনীর অধিনায়ক হলেন? গতকাল প্রসঙ্গটি নিয়ে তার বনানী ওল্ড ডিওএইচএসের বাসায় আলোচনা হয়। সাদেক বলেন, হকি খেলেই আমি পরিচিত লাভ করেছি- এটা বাস্তব সত্য। কিন্তু এই খেলার পাশাপাশি আমি ঢাকা লিগের নিয়মিত ফুটবলার ছিলাম। ঐতিহ্যবাহী আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে ডিফেন্ডার হিসেবে বেশ কয়েকটি মৌসুম খেলি। ১৯৬৬ ও ৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম। তা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
দেশ স্বাধীনের পর শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠা করেন। বলে রাখা ভালো ১৯৭০ সালে দ্বিতীয় বিভাগ লিগে ইকবাল স্পোর্টিং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু দলটি দারুণ অর্থ সংকটে পড়ে। পরবর্তীতে এই ক্লাব কিনে নিয়ে নামকরণ করা হয় আবাহনী। শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাদেক বলেন, তিনি ছিলেন খেলা পাগল মানুষ। মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বললেন, যখন আমরা খেলবই শুরুতে চমক দেখাতে চাই। সিদ্ধান্ত নিলেন ফুটবলে শক্তিশালী দল গড়ার। আমিও চলে এলাম আবাহনীতে। দলে ছিল তারকার ছড়াছড়ি। কার নেতৃত্বে আবাহনী যে মাঠে নামবে এ সিদ্ধান্ত নিতে শেখ কামাল হিমশিম খাচ্ছিলেন। কেননা অনেকে অধিনায়ক হতে চাচ্ছিলেন। এ নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও শুরু হয়ে যায়। কামাল আমাকে ডেকে বললেন, সাদেক ভাই আপনাকেই অধিনায়ক হতে হবে। বললাম, আমি কেন দলে তো ভালো বা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের অভাব নেই। তিনি বললেন, মানলাম আপনার কথা। কিন্তু এটাও আপনাকে চিন্তা করতে হবে, আমরা মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি (বর্তমানে বিজেএমসি) আরও জনপ্রিয় দলের খেলোয়াড়দের এনে শক্তিশালী দল গড়েছি। স্বাভাবিকভাবে ওদের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেবে। এটা তো মাঠে সামাল দিতে হবে। আমি দেখছি দলে আপনিই সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তাই আমি আপনাকে অধিনায়ক করে দল নামাতে চাচ্ছি। তা ছাড়া আপনার ব্যাপারে কেউ আপত্তি তুলবে না। ব্যস, এভাবেই হয়ে গেলাম আবাহনী ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক। ১৯৭২ সালে আমার নেতৃত্বেই মাঠে নামে আবাহনী। উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিপক্ষ দল ছিল বিগত প্রথম বিভাগের চ্যাম্পিয়ন বিজেআইসি। গ্যালারি ভরা এ ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। মাঠে নেমে দেখলাম শেখ কামালের কথাই সত্যি। পুরো গ্যালারি আমাদের বিপক্ষে। ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে খেলতে নেমে মাঠে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ম্যাচে তখন আমরা ১ গোলে এগিয়ে। এরপর পেনাল্টি থেকে টিপু জালে বল পাঠালে স্কোর দাঁড়ায় ২-০-তে। এতেই পুরো মাঠে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের খেলোয়াড়দের এতটা গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছিল যে, অনেককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। এ ঘটনায় সেই মৌসুমে আর লিগ শেষ হতে পারেনি। হলে আমরা যে পজিশনে ছিলাম নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন হতাম। ’৭৪ সালে প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নিহত হন আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালও। এই হত্যা কোনোভাবে জাতি মেনে নিতে পারেনি। কামালের মৃত্যুর পর আবাহনীর সে কি দুর্দশা তা ভাবলেই চোখে পানি চলে আসে। অনুশীলন তো দূরের কথা কোনো খেলোয়াড়ই ভয়ে ক্লাবে যেতে পারতেন না। নির্মম ঘটনার কিছুদিন পরই লিগে আমাদের ম্যাচ ছিল। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে মাঠে যেতে চাচ্ছিলেন না। আমি তখন ধানমন্ডিতেই থাকতাম। এই অবস্থায় কীভাবে আমরা খেলব তা নিয়ে প্রতিদিনই আমার বাসায় বৈঠক বসত। আমি দেখলাম আবাহনীকে বাঁচাতে হলে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যারা ছিলেন কেউ তখন গ্রেফতার বা ভয়ে আত্মগোপন করে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা লিগ খেলব। এ ছাড়া উপায়ওছিল না। এমনিতেই আবাহনীকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ছিল। এখন যদি খেলতে না যায় তাহলে তো লিগ থেকে বহিষ্কারের সুযোগ পাবে। সিদ্ধান্ত হলো স্টেডিয়ামে খেলতে যাব কিন্তু একসঙ্গে নয়। তাহলে রাস্তায় সবাইকে গ্রেফতার করে ফেলতে পারে। কেউ রিকশায়, কেউ স্কুটারে হাজির হলাম। ভয়ে ছিলাম মাঠে নামলে কি পরিণতি না হয়। মাঠে নেমেই গ্যালারির দৃশ্য দেখে খুশিতে চোখে পানি এসে পড়ল। পুরো গ্যালারি আবাহনী, আবাহনী স্লোগানে মাতোয়ারা। সবার ভালোবাসা পেয়ে আজ আবাহনী দেশের জনপ্রিয় দলে রূপান্তরিত হয়েছে। ’৭৭ সাল পর্যন্ত খেলে অবসরগ্রহণ করি। পরবর্তীতে ফুটবল দলের প্রশিক্ষকও ছিলাম। আবাহনীর হকি দল আমার হাতেই গড়া। ইস্পাহানি থেকে সাব্বির ইউসুফ, ইব্রাহিম সাবের অন্য দল থেকে প্রতাপ শংকর হাজরা বা শামসুল বারীর মতো বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়ি। স্বাধীনতার পর ফুটবল, হকি বা ক্রিকেট লিগের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখবেন শিরোপার দিক দিয়ে আবাহনী এগিয়ে। শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগআপ্লুত কণ্ঠে সাদেক বলেন, আবাহনী সৃষ্টি করে কামাল প্রমাণ দিয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গনে তার যোগ্যতা। শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে অথচ তার ভিতরে কখনো অহঙ্কার দেখেনি। যতটুকু মিশেছি আমি তাকে দেখেছি শুধু ক্রীড়ার উন্নয়ন নিয়েই ভাবতে। বলতে পারেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়ার আবির্ভাব ঘটান তিনিই। তার যোগ্যতাকে কোনো সরকারই মূল্যায়ন করেননি। অনেকে মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার পেলেও শেখ কামালের নামটি থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এ নিয়ে আমার আবাহনীর ওপরও অভিমান রয়েছে। সেই কবে থেকে বলা হচ্ছে আবাহনী মাঠে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তি স্থাপনও করে গেছেন। অথচ কষ্ট লাগে এক সাইনবোর্ড লাগানো ছাড়া কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমি মনে করি কামালের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে অবশ্যই কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু করা দরকার।
ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আবদুস সাদেকের স্মৃতিচারণ
কামালের মৃত্যুর পর আবাহনীর সে কি দুর্দশা তা ভাবলেই চোখে পানি চলে আসে। অনুশীলন তো দূরের কথা কোনো খেলোয়াড়ই ভয়ে ক্লাবে যেতে পারতেন না। নির্মম ঘটনার কিছুদিন পরই লিগে আমাদের ম্যাচ ছিল। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে মাঠে যেতে চাচ্ছিলেন না। আমি তখন ধানমন্ডিতেই থাকতাম। এই অবস্থায় কীভাবে আমরা খেলব তা নিয়ে প্রতিদিনই আমার বাসায় বৈঠক বসত। আমি দেখলাম আবাহনীকে বাঁচাতে হলে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে
শিরোনাম
- যুক্তরাজ্যে ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি, নজরে পাকিস্তানসহ একাধিক দেশ
- বাংলাদেশ-সৌদি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: প্রথম যৌথ কমিটির সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত
- ৬ বছর বয়সী ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর’ সেই মেয়ের বয়স এখন ২৪, তবে...
- দুই দিনের বৃষ্টিতে গুজরাটে ১৪ জনের মৃত্যু, আহত ১৬
- ধর্ষণের অভিযোগে ভারতীয় ক্রিকেটার গ্রেফতার
- সকালে পরাজয়, বিকালে জয়ী জার্মানির চ্যান্সেলর মেৎস
- বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রাণ গেল বরের
- ফিফার অনুমোদন, বাংলাদেশের হয়ে খেলতে বাধা নেই সামিতের
- কানাডা থেকে আলাদা হতে চায় আলবার্টা!
- নতুন করে যেন রোহিঙ্গা না আসে সেই চেষ্টা করছি : খলিলুর রহমান
- ৭ দিনের মধ্যে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধ না হলে রংপুরে ধর্মঘটের হুঁশিয়ারি
- উল্টো পথে চলাচলে ডিএমপির দেড় শতাধিক মামলা
- ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানে বিস্ফোরণ, ৭ সেনা নিহত
- অভিবাসন বিষয়ক এমওইউ স্বাক্ষর, ইতালির মন্ত্রীর সফরের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
- শুল্কযুদ্ধের পরিণতি, আমেরিকায় বাণিজ্য ঘাটতিতে নতুন রেকর্ড
- ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস ইয়েমেনের সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
- মহেশখালীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে যুবক নিহত
- দেশজুড়ে অভিযানে অস্ত্রসহ গ্রেফতার ১৬৭৬
- সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
- স্কুলছাত্র হাত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে গাইবান্ধায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন
শেখ কামাল বললেন আপনিই অধিনায়ক
ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর