আর্জেন্টিনা-চিলির জন্য সময়টা কোনো অংশেই যুদ্ধ পরিস্থিতির চেয়ে কম উত্তেজনার নয়। দুই দেশ ৫ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একই সীমান্ত লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিটা ঘোলাটে হয়েছে সীমান্ত নয়, ফুটবল নিয়ে। যদিও ফুটবলাররা বলছেন, অতীতে যা হয়েছে তা ভুলে যেতে হবে আমাদের। এটা ফুটবল, কোনো যুদ্ধ নয়। আর্জেন্টিনা আর চিলি এখন ভাই ভাই। ফুটবলারদের এ আহ্বান যে ভক্তদের কর্ণকুহরে আদৌ প্রবেশ করেনি তা সেমিফাইনালেই বোঝা গেছে। চিলির জঙ্গি সমর্থক গোষ্ঠী প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের ইচ্ছামতো গালিগালাজ করেছে। আর দুই দেশের মিডিয়াও পরস্পরের দিকে তোপ দাগাচ্ছে প্রতিদিন। আর্জেন্টাইন মিডিয়া বলছে, আমাদের একজন জাদুকর আছেন। তাদের ভাষায়, চিলি নাকি মেসিদের ভয়েই কাবু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। কয়েকটা দৈনিক এরই মধ্যে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়নের খেতাবও দিয়ে দিয়েছে! আর চিলির মিডিয়া আর্জেন্টিনার প্রতি বিদ্রূপ করে লিখেছে, ব্রাভোর শিশুপুত্রকে দেখেছ, কী দারুণ! অন্তত ওদের (মেসিদের) চেয়ে ভালোই পাস-টাস দিচ্ছে অনুশীলনে। এমন যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই আজ বাংলাদেশ সময় মধ্যরাত পেরিয়ে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে মুখোমুখি হচ্ছে দুই প্রতিবেশী। কোপা আমেরিকার ফাইনালে নামছে আর্জেন্টিনা-চিলি।
লিওনেল মেসি তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভক্তদের জন্য একটা ছবি পোস্ট করেছেন। সামনে সাজানো আট জোড়া বুট। হাতে এক জোড়া। ক্যাপশনে লেখা : 'প্রতি জোড়া বুটই কোনো না কোনো জয়ের সাক্ষী। এ তালিকায় আরও এক জোড়া যোগ করতে চাই।' কোপা আমেরিকা জিততে মেসি যে কতটা সিরিয়াস এ ছবি তার একটা প্রমাণ। তা ছাড়া নিজের খেলায়ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন কোপা জয়ের স্বার্থে! নেমে আসছেন অনেকটা নিচে। ছোট পাসে জায়গা তৈরি করছেন সতীর্থদের জন্য। মার্কারদের টেনে আনছেন নিজের দিকে। এতে গোলের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন ডি মারিয়া, আগুয়েরো, পাস্তোরে। চিলির ডিফেন্স লাইনের জন্য আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে মেসিকে বুঝে ওঠা। উইংয়ে তাকে ধরতে গেলে মেসি স্থান বদলে চলে যেতে পারেন সেন্টারে। আবার কখনো দেখা যাবে তাকে পুরোদস্তুর প্লে-মেকার হিসেবে। মেসি গোল করছেন না বটে, কিন্তু তার ছন্দটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুরো দলের মধ্যে। সব মিলিয়ে চিলি মেসিকে কেন্দ্র করে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করলেই সমস্যায় পড়বে তারা। আর মেসিকে যদি মুক্তভাবে খেলতে দেওয়া হয় তবে তিনি যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছে ফুটবল দুনিয়া।
আর্জেন্টিনার এমন দুর্দান্ত একটা দলের বিপক্ষে বিশ্বের কোনো দলেরই তেমন কিছু করার নেই। তার পরও ম্যাচটা চিলির মাটিতে। সান্তিয়াগোতে মেসিদের ১১ জন চিলিয়ান ফুটবলারের পাশাপাশি লড়তে হবে প্রায় ৫০ হাজার দর্শকের সঙ্গে। যাদের সানচেজরা এরই মধ্যে যুদ্ধে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, নীরবে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা আর্জেন্টাইনদের সম্ভব না-ও হতে পারে। চিলিয়ান সমর্থকরা মেসিদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার পরও ২২ বছর পর কোপা আমেরিকা জয়ের জন্য মরিয়া আর্জেন্টিনা। আর প্রথমবারের মতো নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে বড় কিছু জয় করতে মরিয়া চিলিও। সানচেজ, ভিডাল আর ভারগাসদের পাশাপাশি দলটাতে আছেন ক্লাউডিও ব্রাভো। এমন দুরন্ত একটা দল চিলির ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। অতীতে যদিও চিলির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ৮৩ ম্যাচ খেলে জিতেছে ৫১টা, হেরেছে মাত্র ৬টা, তার পরও কোপা আমেরিকার ফাইনাল ঘিরে মেসিদের মধ্যে রয়েছে বাড়তি সতর্কতা। নিজেদের প্রতি চরম আত্দবিশ্বাস থাকার পরও তারা সতর্ক চোখে মাপছে প্রতিপক্ষ চিলিকে।
আর্জেন্টাইনরা আজ প্রাণভরে প্রার্থনায় রত হবে মেসি যেন ম্যারাডোনা, পেলে, গ্যারিঞ্চা কিংবা জিকোদের তালিকায় স্থান নিতে না পারেন। এই কিংবদন্তিরা কত কিছুই না জিতেছেন। কিন্তু কোপা আমেরিকায় ভাগ্যদেবী তাদের বর দেননি কোনোকালেই। মেসিও তো একে একে তিনটি কোপায় অংশ নিলেন। প্রথমবারে ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরেছিলেন। দ্বিতীয়বার তো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেই বিদায়। এবার কী? মেসি পারবেন তো আর্জেন্টিনার স্বপ্ন পূরণ করতে? নাকি সানচেজদের দাপুটে ফুটবলে এবারও হারিয়ে যাবে তার ছন্দ? না নাম লেখাবেন পেলে-ম্যারাডোনাদের সারিতে?