বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক (এবি সিদ্দিক) গত দুই দিনেও উদ্ধার হননি। তবে তাকে উদ্ধারের জন্য র্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অন্যদিকে, এ বি সিদ্দিককে উদ্ধারের জন্য গতকাল রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপহৃতের ব্যবসায়িক বিরোধ, স্থানীয় অপরাধী চক্র, স্ত্রী রিজওয়ানার পেশাগত শত্রুতা এবং তাদের পারিবারিক সমস্যা এসব কারণগুলোকে সামনে রেখে অপহরণের ঘটনার তদন্ত চলছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে রিজওয়ানা ও তার স্বামীর মুঠোফোনের কললিস্ট।
সূত্র আরও জানায়, অপহৃত এ বি সিদ্দিক ফতুল্লার দাপা এলাকায় হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত দাপার 'ঝুট' ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধও রয়েছে। ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে সিদ্দিকের বিরোধ রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এদিকে অপহৃতের গাড়িচালকের বক্তব্য এবং যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সিসিটিভি থেকে প্রাপ্ত ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, অপহরণে নীল রঙের একটি মাইক্রোবাস ব্যবহৃত হয়। তবে ওই গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল চট্টগ্রাম মেট্রো-গ-১৭-৮৩২৭)। পরে চট্টগ্রাম বিআরটিএ নিশ্চিত করেছে, ওই রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি ভুয়া। তিনি বলেন, এ বি সিদ্দিককে অপহরণের সময় তার গাড়িচালক রিপনকে পিপার স্প্রের মতো এক ধরনের স্প্রে ব্যবহার করে অপহরণকারী চক্র। এ থেকেই বোঝা যায় ওই চক্রটি পেশাদার এবং অত্যন্ত দক্ষ। এখন গাড়িচালকের শরীরের কাপড়-চোপড় ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখা হবে।
পুলিশ হেফাজতে থাকা গাড়িচালক রিপন জানিয়েছেন, প্রায় দুই কিলোমিটার ধরে নীল রঙের একটি 'হাইয়েস' মডেলের মাইক্রোবাস তাদের গাড়িকে অনুসরণ করে আসছিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দেলপাড়া এলাকায় ভূইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে এলে ওই মাইক্রোবাসটি তাদের গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এ সময় গাড়ি থামিয়ে দেখতে গেলে মাইক্রোবাস থেকে অস্ত্রধারী কয়েকজন নেমে তার চোখে-মুখে এক ধরনের স্প্রে করে এবং তার বসকে (এ বি সিদ্দিক) নিয়ে চলে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক বছরে নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক অবনতি হয়েছে। এক বছরে অন্তত দেড় ডজন ব্যক্তি দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয়েছেন। এসব খুনের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, এ বি সিদ্দিকের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সম্ভাব্য সবকিছুকেই আমলে এনে অন্যসব সংস্থার মতো র্যাবও তৎপর।
এদিকে রিজওয়ানা হাসান গতকাল র্যাব সদর দফতর, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে এসে তার স্বামীকে উদ্ধারে তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। পরে বিকালে ব্র্যাক সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজওয়ানা হাসান বলেন, অপহরণের ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাকে সহযোগিতা করছেন। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো খবর না দিতে পারলেও তারা হতাশার কিছু বলেননি। আমি তাদের প্রতি আস্থাশীল। সরকারও আন্তরিক। তিনি বলেন, এজাহারে উল্লেখ না করলেও আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি আমার আন্দোলনের কারণে যেসব কোম্পানি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের যেন নজরদারিতে রাখা হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ড. হামিদা হোসেন, স্থপতি ইকবাল হাবিব, অধ্যাপক সাদিকা হালিম, ড. বদিউল আলম মজুমদার, খুশী কবির, ইফতেখারুজ্জামান, অ্যাডভোকেট এলিনা খান, ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম প্রমুখ। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, রিজওয়ানা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিদ। তার স্বামী এভাবে দিনদুপুরে নিখোঁজ হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা জানি, সরকার আন্তরিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমাদের আস্থা আছে। তারা আগেও অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছেন। আমরা আশা করব, তারা এ কাজটা করে আমাদের প্রিয়জনকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, এমন ঘটনা যদি ঘটতেই থাকে, তবে সরকারকে বলতে চাই, গণতন্ত্র কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। বর্তমান সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক এবং গণপ্রতিনিধিত্বশীল দাবি করে। কিন্তু এমন ঘটনা এ দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে বাধ্য। তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখতে চাই। একই সঙ্গে দাবি করছি তারা যেন এ বি সিদ্দিককে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন মনে রাখে, তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং আজকে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা যেন মনে রাখেন এটা তাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে যদি ব্যর্থ হন তাহলে অবশ্যই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা আমাদের স্বজনকে ফেরত চাই।
সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ হয়েছে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী : গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, এ বি সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটির খবর পেয়েছি। আশা করছি তা শীঘ্রই উদ্ধার সম্ভব হবে। এ বি সিদ্দিককে অক্ষত উদ্ধারে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছে। অপহরণের ঘটনা খুঁটিনাটি আমলে নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। প্রসঙ্গত, বুধবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দেলপাড়া এলাকায় ভূইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে অপহৃত হন এ বি সিদ্দিক। এ ঘটনায় বুধবার রাতেই রিজওয়ানা হাসান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৮ জনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন।
তদন্ত সহায়তায় বিশেষ টিম : এদিকে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) জালাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী জানান, এ বি সিদ্দিককে উদ্ধারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সার্বিক সহায়তার জন্য পুলিশ সদর দফতরের উদ্যোগে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসানের নেতৃত্বে টিমের অন্য সদস্যরা হলেন ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম, র্যাব-৩ এর উপপরিচালক মেজর সাদিকুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান এবং পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান।