রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের এসপিআরসি অ্যান্ড নিউরোলজি হাসপাতালের পাশের সরু গলিতে ঢুকলেই আতঙ্কের গন্ধ পাওয়া যায়। মাত্র কয়েক ফুট প্রস্থের সেই রাস্তায় পরপর দুটি ম্যানহোল, যেগুলোর ঢাকনা অনেক দিন ধরে নেই। পথচারীরা জানেন, এখানে পা ফসকালেই জীবন শেষ। কিন্তু গলি তো ব্যবহার করতেই হবে। তাই প্রতিদিনই তারা মৃত্যুফাঁদ টপকে যান, বুকের ভিতর ভয় নিয়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা চাকরিজীবী আবদুল হালিমন, প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতের সময় এই পথ ব্যবহার করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে চলাচল মানেই আতঙ্ক। বৃষ্টি হলে পানি জমে সব ঢেকে যায়। তখন বোঝাই যায় না কোথায় রাস্তা আর কোথায় গর্ত। আমাদের বারবার অভিযোগের পরও ঢাকনা লাগানো হয়নি।’
শুধু ইস্কাটন নয়, মগবাজার এলাকার শহীদ তাজউদ্দীন সড়কের ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পেছনের সড়ক, (এ এইচ এম কামরুজ্জামান সরণি), পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড, মিটফোর্ড রোড, বনানী, কাকরাইলসহ অসংখ্য জায়গায় ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল দেখা গেছে। ঢাকনাবিহীন এসব ম্যানহোলে পথচারীদের সতর্ক করতে লাঠির সঙ্গে লাল কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো বৃষ্টির দিনের পরিস্থিতি। কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে পানি জমে রাস্তায় একরঙা জলছবি তৈরি হয়। খোলা মুখগুলো তখন অদৃশ্য, যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে অসতর্ক পা ফসকানোর জন্য।
গত ২৭ জুলাই গাজীপুরের টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায় ঠিক এমনি এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ফারিয়া তাসনিম ওরফে জ্যোতি নামে এক নারী। সন্ধ্যার পর বৃষ্টির পানি জমা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তিনি ঢাকনাবিহীন নালায় পড়ে যান। নিখোঁজ হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পর তাঁর লাশ উদ্ধার হয় কয়েক কিলোমিটার দূরে শালিকচূড়া বিল থেকে। ঢাকায় ম্যানহোলের ঢাকনা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ চুরি। ঢাকনাগুলো সাধারণত লোহার তৈরি, যা স্ক্র্যাপ বাজারে ভালো দামে বিক্রি হয়। ফলে রাতের অন্ধকারে সেগুলো উধাও হয়ে যায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির বিষয়ে আমাদের কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ আসেনি। তবে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ নগরবাসীর প্রশ্ন, যে চুরি সবার চোখের সামনে ঘটছে, তার জন্য অভিযোগের অপেক্ষা কেন?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকনা চুরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু চুরি ঠেকানো এবং চুরি হওয়া ঢাকনা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে কেউ পড়ে গিয়ে আহত বা নিহত হলে তার দায়ভারও কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। আইন থাকতে হবে, যাতে এমন অবহেলার জন্য দায়ীদের শাস্তি হয়। তবেই কর্তৃপক্ষ তৎপর হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মাহবুবুর রহমান তালুকদার স্বীকার করলেন সমস্যার কথা। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা খবর পেলেই ঢাকনা লাগানোর ব্যবস্থা করছি। তবে বাজেট স্বল্পতা এবং রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় কাজ ধীরগতিতে হচ্ছে। প্রায় দেড় মাস কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবুও আমরা এখন নতুন পদ্ধতিতে ফাইবার দিয়ে ঢাকনা তৈরি করছি, যা চুরি হয় না। এগুলো এমনভাবে বানানো হচ্ছে যে ২৫ থেকে ৩০ টনের গাড়িও এর ওপর দিয়ে যেতে পারবে।’ তবে স্থানীয়রা বলছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবে কবে নাগাদ সম্পূর্ণ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা মুদি দোকানি রহিমা বেগম বলেন, ‘আমার দোকানের সামনে একটা ম্যানহোল আছে, কয়েক মাস ধরে ঢাকনা নেই। শিশুরা খেলতে খেলতে কাছে চলে যায়, আমি ভয় পাই। রাতে যদি কেউ পড়ে যায়, কী হবে?’
কাকরাইলের রিকশাচালক শফিকুল বলেন, ‘আমরা রিকশাও ওদিক দিয়ে নিতে চাই না। বৃষ্টির রাতে কিছুই দেখা যায় না।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাধান শুধু ঢাকনা লাগানো নয়, বরং নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এমন উপকরণ ব্যবহার করা যা চুরি করা যাবে না, যেমন ফাইবার বা কংক্রিট এবং ম্যানহোলের অবস্থান ডিজিটাল মানচিত্রে রেখে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নজরদারি রাখতে হবে। যেহেতু এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের। তাদের যেসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন, তারা তো জানেন কোথায় কোন ম্যানহোলে ঢাকনা নেই। তাদের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন জেনে নিয়ে তা প্রতিস্থাপন করতে হবে।