রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বকাপে যত অদ্ভুত কাণ্ড

আবদুল কাদের

বিশ্বকাপে যত অদ্ভুত কাণ্ড

ফুটবলের মহারণ- বিশ্বকাপ। ৯০ মিনিটের খেলা! তবে তা জন্ম দেয় অসংখ্য ঘটনার। ১৯৭৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল সাক্ষী হয়েছে অদ্ভুত সব ঘটনার। তবু প্রতিযোগিতার এ আসরে রণাঙ্গনের মতোই যে কোনো সময় ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত কাণ্ড-কারখানা। আর সেসব ঘটনাপ্রবাহ ফুটবল বিশ্বে বারবার উঠে আসে আশ্চর্যজনক ঘটনা হিসেবে।  আজ জানব তেমন কিছু ঘটনা...

 

অচেনা রোনালদো

লুইস নাজারিও ডি লিমা নামে পরিবারের বাইরে তাকে কেউ চেনে কি না, কে জানে। কিন্তু সবাই তাকে রোনালদো নামেই চেনেন। ১৯৯৪ সালে এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের উত্থান। ম্যাচের পুরো ৯০ মিনিট অলস-ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের আশপাশে হেঁটে বেড়ালেও ওই জায়গায় বল পায়ে তার চেয়ে বিপজ্জনক খেলোয়াড় আর কেউ নন। বিশ্বকাপের আসরে এখনো পর্যন্ত ১৫টি গোল করে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। যে উচ্চতা তাঁকে ফুটবল ইতিহাসেই এনে দিয়েছে অমরত্ব। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপেই ফাইনালের আগ পর্যন্ত ৪ গোল করে ফাইনালে ওঠায় বড় ভূমিকাও রেখেছিলেন রোনালদো। কিন্তু ফাইনালে আর রাখা হয়নি। আকস্মিক অনুপস্থিতিতে জানা গেল, রোনালদো অসুস্থ। বলা হয়েছিল, ম্যাচের দিন রোনালদো ‘কনভালসিভ ফিট’ বা এক ধরনের মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাই মূল একাদশে তার জায়গায় এডমুন্ডোকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই পরিবর্তিত মূল একাদশে এডমুন্ডোর জায়গায় ফেরানো হয় রোনালদোকে। কিন্তু ম্যাচে ফিরলেও অসুস্থতার কারণে সেবারের ফাইনালে তাকে চেনারূপে দেখা যায়নি। ফাইনালের পুরো ৯০ মিনিট রোনালদো যেন ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে, গোল করা দূরের কথা, স্বাভাবিক খেলাই খেলতে পারেননি।

 

জিনেদিন জিদানের ঢুস!

২০০৬ সালের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের হাত ছোঁয়া দূরত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে মাঠ ছাড়ছেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি তারকা জিনেদিন জিদান। দৃশ্যটা সত্যিই ছিল হৃদয়বিদারক। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপে। সেবার ফ্রান্সের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, দলকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত দলের কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান, লিলিয়ান থুরাম প্রমুখকে অবসর ভেঙে চলে আসতে হয়। সেবার জিদানের ছন্দময় ফুটবলে পুনরুজ্জীবিত ফ্রান্স উঠে গেল ফাইনালে। আর প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী ইতালি। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে সমতায় থাকা ম্যাচটা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এর পরই বিশ্ব দেখে আশ্চর্যজনক ঘটনা। ঠাণ্ডা মেজাজি জিনেদিন জিদান হঠাৎ করেই ইতালি ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জির বুকে ঢুস মেরে বসেন! পরে জানা গেল, জিদানকে উত্ত্যক্ত করতে তার বোনকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিলেন মাতেরাজ্জি। তা সইতে না পেরে ঢুস মেরে বসেন মাতেরাজ্জিকে। পরিণামে দেখতে হয় লালকার্ড!  সেই সঙ্গে হাতছাড়া হয়ে যায় বিশ্বকাপ।

 

লুইস সুয়ারেজের কামড়!

সালটা ২০১৪। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মাঠে গড়ায় ব্রাজিল বিশ্বকাপ। সেবারের আসরে উরুগুয়ের ফরোয়ার্ড লুইস সুয়ারেজ এমন এক কাণ্ড ঘটান, যা সমগ্র বিশ্বে তোলে নিন্দার ঝড়। জানা গেছে, ব্রাজিল বিশ্বকাপে সেবার গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হয়েছিল উরুগুয়ে ও ইতালি। সে ম্যাচে উরুগুয়ের হয়ে খেলছিলেন লুইস সুয়ারেজ। অন্যদিকে ইতালির ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন জর্জিও কিয়েল্লিনি। ভালোভাবেই চলছিল ম্যাচটি। হঠাৎ ৭৯ মিনিটে কিয়েল্লিনির কাঁধে কামড় বসিয়ে দেন সুয়ারেজ। ব্যথায় রীতিমতো কাঁতরাতে থাকেন ইতালিয়ান ফুটবলার। অন্যদিকে সুয়ারেজের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, যেন কামড় দিয়ে নিজেই দাঁতে ব্যথা পেয়েছেন। রেফারি মার্কো রদ্রিগেজের চোখে পড়েনি বিষয়টা, ফলে সুয়ারেজকে কোনো কার্ডও দেখতে হয়নি। কিন্তু কিয়েল্লিনি তা মানবেন কেন? রেফারিকে কামড়ের দাগ দেখাতে কাঁধের ওপর থেকে জার্সি সরিয়ে তিনি ছুটে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। পরে এই কাণ্ডের জন্য সুয়ারেজকে ১ লাখ সুইস ফ্রা, ৯ ম্যাচ ও চার মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এমন ঘটনা যে সুয়ারেজ ২০১৪ বিশ্বকাপেই প্রথম ঘটিয়েছেন তা অবশ্য নয়। এর আগেও তার কামড়ের শিকার হয়েছেন আরও দুই ফুটবলার।

 

নিষিদ্ধ ম্যারাডোনা!

আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর দিয়েগো ম্যারাডোনা। অনেকে তাকে বলেন ফুটবলের ঈশ্বর। তার হাত ধরেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভেসেছিল আর্জেন্টাইন ভক্তরা। এই বিশ্বকাপেই বিশ্ববাসী ম্যারাডোনার কাছ থেকে দেখেছিল ইতিহাস কাঁপানো দুই গোল। যদিও দেশকে আনন্দে ভাসানো ম্যারাডোনা একটুর জন্য পরের আসরে আর্জেন্টিনাকে আরেকটা শিরোপা এনে দিতে পারেননি। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হারে আর্জেন্টিনা। ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ ম্যারাডোনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলেও ম্যারাডোনা ভক্তরা ভুলবে না ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের ধারণা। বিশ্বকাপটা ছিল আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির শেষ সুযোগ। গ্র“প পর্বের প্রথম দুই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলার পর হুট করেই শোনা গেল, ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার! সেবার ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে দুটো ম্যাচ খেলেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত যেতে হয় ম্যারাডোনাকে। আর আর্জেন্টিনাও বাদ পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে! ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনীতে ’৯৪ বিশ্বকাপের ডোপ টেস্টে ধরার বিষয়ে বলেছেন, তার ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক তাকে এনার্জি ড্রিংক রিপ ফুয়েল দেওয়ার কারণে তিনি ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়েছেন। তিনি দাবি করেন, ওই রাসায়নিক দ্রব্যটি তার প্রশিক্ষক অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করেছিলেন। ম্যারাডোনাকে বহিষ্কারের ঘটনাকে তার ভক্তরা ষড়যন্ত্র হিসেবেই মনে করেন। যদিও ম্যারাডোনার জীবনে মাদক গ্রহণে বহিষ্কারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ফুটবল ক্লাব নেপোলিতে থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালেও ড্রাগ টেস্টে কোকেনের জন্য ধরা পড়ে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা।

 

বিশ্বকাপে এত অ্যালকোহল!

২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল। এবারের আসরের  শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এসে স্টেডিয়াম এলাকায় অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। জানা গেল, মুসলিম দেশ হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে মাঠে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগের আসরগুলোয় স্টেডিয়াম এলাকায় অ্যালকোহল নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়েছিল। আয়োজক যে দেশই হোক- মাঠের লড়াই উপভোগে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের বিয়ার থাকা চাই-ই চাই। বিশ্বকাপের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সময়, স্টেডিয়ামগুলোয় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ (৭ লাখ ৫০ হাজার) লিটারের বেশি বিয়ার বিক্রি হয়েছিল। অবাক হবেন এটা জেনে যে, তা ছিল প্রায় ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৬৪ বিয়ারের সমতুল্য। এর আগের বিশ্বকাপগুলোতেও অ্যালকোহলের এমন ছড়াছড়ি দেখেনি বিশ্ব।

 

বিতর্কিত বায়রন মরেনো

২০০২ সালের বিশ্বকাপে অন্যতম ফেবারিট ছিল ইতালি। আর থাকবেই না কেন! ফ্রান্সিসকো টট্টি, দেল পিয়েরো, বুফন, গাত্তুসো, ভিয়েরি সমৃদ্ধ প্রতিভাবানে ঠাসা ইতালির ফুটবল দল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দ্বিতীয় রাউন্ডে কোরিয়ার কাছে হেরে বিদায় নেয় ইতালি। জানা গেছে, ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ৮৮ মিনিটে দক্ষিণ কোরিয়ার কি হিউন এক গোল করে দলকে সমতায় ফেরান। পরে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু ১১৮ মিনিটের ‘গোল্ডেন গোল’ করে ইতালিকে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে ফেলেন আন জুন হুয়ান। আর এই ম্যাচে সবাই মনে রেখেছে রেফারি বায়রন মরেনোকে। জঘন্যতম রেফারিং করেছিলেন মরেনো। অতিরিক্ত সময়ে ড্যামিয়ানো টমাসির গোল খামোখাই অফসাইড ডেকেছিলেন মরেনো। এ ছাড়া বিনা কারণে টট্টিকে লালকার্ড দেখান তিনি। সেবার ইতালি হেরে গিয়েছিল। শুধু মাঠেই নন, মাঠের বাইরেও বিতর্কিত ইকুয়েডরের এই রেফারি। ২০১০ সালে নিউইয়র্কের কেনেডি বিমানবন্দরে ৬ কিলোগ্রাম হেরোইনের ১০টি পরিষ্কার প্লাস্টিকের ব্যাগসহ আটক হন মরেনো। এ খবরের শিরোনাম হয়েছিল সুদূর ইতালিতেও।

 

গোল না পাওয়া ল্যাম্পার্ড

ইংলিশ ফুটবলে সেরা তারকাদের তালিকায় ল্যাম্পার্ডের নাম থাকবেই। তার পুরো নাম ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। ক্লাব ফুটবলে মাঠ কাঁপালেও বিশ্বকাপে যেন গোলের দেখা পান না এই ফরোয়ার্ড। ইংল্যান্ডের হয়ে ২০০৬, ২০১০, ২০১৪- টানা তিন বিশ্বকাপ খেললেও একটিও গোল আদায় করতে পারেননি তিনি। অবশ্য ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে তার করা একটি গোল নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। সেই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১০ বিশ্বকাপে। সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে জার্মানির মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। ৩২ মিনিটেই মিরোস্লাভ ক্লোসা আর লুকাস পোডলস্কির গোলে এগিয়ে যায় জার্মানরা। ৩৭ মিনিট থেকে ধীরে ধীরে ম্যাচে ফিরতে শুরু করে ইংলিশরা। ডিফেন্ডার ম্যাথিউ আপসনের গোলে ব্যবধান কমায় ইংল্যান্ড। এরপর ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের এক গোল গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যারকে পরাস্ত করে গোললাইন অতিক্রম করলেও গোল দেননি রেফারি! পরে সেই ম্যাচ ৪-১ গোলে হারে ইংলিশরা। অনেকের মতে, ল্যাম্পার্ডের সেই গোলটা হলে হয়তো ম্যাচে ফিরতে পারত ইংলিশরা। তাই অফিশিয়ালি বিশ্বকাপে কোনো গোল না করাদের তালিকাতেই চলে যান ল্যাম্পার্ড।

সর্বশেষ খবর