বিশ্বকাপের কত রং! কত ঘটনা। কত দুর্ঘটনায় পরিপূর্ণ বিশ্বকাপের ইতিহাস। একদিকে হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে হৃদয় ভাঙার গল্প। একদিকে অঘটন, অন্যদিকে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের রচনা। কাতার বিশ্বকাপটা কি তাহলে অঘটন আর ইতিহাসের নতুন নতুন অধ্যায় রচনার বিশ্বকাপ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকাপের সেসব বিচিত্র ঘটনা নিয়ে মালা গাঁথলে কিন্তু মন্দ হয় না। এ নিয়ে আমাদের রকমারি ডেস্কের আয়োজন।
ফাইনালের মহারণে ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা
আজ শেষ হচ্ছে বিশ্বকাপের মহারণ। শেষ বাঁশির মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটবে কাতার বিশ্বকাপ-২০২২ আসরের। এবারের ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা। যদিও এর আগে ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল। তবে অধরা থেকে যায় বিশ্বকাপ। জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার।
বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স নাম লেখানোর পর থেকেই আলোচনা চলছে। গত বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। সেই পরাজয়ের মোক্ষম প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ লিওনেল মেসিদের সামনে। পাশাপাশি বিশ্বকাপে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘুচানোর সুযোগও আছে আলবেসিলেস্তদের। তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতে ফ্রান্স ও উরুগুয়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনা। দুটি করে বিশ্বকাপ জিতে তিন দলই বর্তমানে আছে সমান্তরালে। কিন্তু ফ্রান্সও বিশ্বকাপ ট্রফির দিকে পাখির চোখ করে তাকিয়ে আছে। টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতে তারা ব্রাজিল ও ইতালির পাশে নাম লেখাতে চায়। ব্রাজিল ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতেছে। বিশ্বকাপে এমন ঘটনা ওটাই ছিল শেষ।
এবারের কাতার বিশ্বকাপে দারুণ দলীয় সমন্বয় আর্জেন্টিনাকে এনে দিচ্ছে সাফল্য। আক্রমণভাগে মেসি ছাড়া সাফল্য পেয়েছেন জুলিয়ান আলভারেজ এবং ম্যাক অ্যালিস্টার। রক্ষণভাগের দায়িত্বে থাকবেন নাহুয়েল মলিনা, ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, নিকোলাস ওটামেন্ডি এবং নিকোলাস টাগলিফিয়াকো। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তাবে মলিনার ওপর। কারণ তাকে সামলাতে হবে এমবাপ্পেকে। মিডফিল্ডে আর্জেন্টিনার গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় রদ্রিগো ডি পল। তার গতি এবং স্কিল আর্জেন্টিনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে থাকবেন লেনার্দো পারেদেস। ফ্রান্স দল সমর্থনের দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও অভিজ্ঞতার দিক থেকে মোটেও পিছিয়ে নেই। গোলরক্ষক উগো লরিস থেকে শুরু করে স্ট্রাইকার জিরু, সবারই বড় ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। আসলে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জনকারী দল দুটির সামর্থ্যে কোনো ঘাটতি নেই। কোনো দিক থেকে পিছিয়েও নেই কেউ। সমস্যা একটিই এবং সেটি হলো প্রত্যাশার চাপ। এ চাপ সামলে যারা সাবলীল খেলতে পারবে তারাই শিরোপা উল্লাসে মাতবে। ফাইনালে কেবল শিরোপা নির্ধারণ হবে না একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি গোলদাতাও নির্ধারিত হবে এ ম্যাচে। লিওনেল মেসি এবং এমবাপ্পে ৫টি করে গোল দিয়ে আছেন যৌথভাবে শীর্ষে। ফাইনালে উভয়ই সুযোগ পাবেন একে-অপরকে (প্রতিপক্ষ) ছাড়িয়ে যাওয়ার।
কোন বলে কত গোল?
১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের প্রথম আসর। কিন্তু ফিফার অফিশিয়াল ম্যাচ বল চালু করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৪০ বছর। এর আগের বিশ্বকাপ পর্যন্ত বল সরবরাহ করত স্বাগতিক দেশ। ১৯৭০ সালের প্রথম ফিফা অফিশিয়াল বল টেলস্টার দিয়ে খেলা শুরু করে। সেবার টেলস্টার বলে গোল হয়েছিল ৯৫টি। এরপর আসে টেলস্টার ডুরলাস্ট (১৯৭৪)। সেবার গোল হয়েছিল ৯৭টি। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আসে ট্যাঙ্গো, আর গোল হয় ১০২টি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ট্যাঙ্গো এসপানা, গোল হয় ১৪৬টি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে অ্যাজটেকা, গোল হয় ১৩২টি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে আসে ইতোরাস্কো ইউনিকো, গোলের দেখা মেলে ১১৫টি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে কুয়েস্ট্রা, গোল হয় ১৪১টি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ট্রিকালার, গোল হয় ১৭১টি। ২০০২ বিশ্বকাপে ফেভারনোভা, গোল হয় ১৬১টি। ২০০৬ বিশ্বকাপে টিমগাইস্ট, গোল হয় ১৪৭টি। ২০১০ বিশ্বকাপে জাবুলানি, গোল হয় ১৪৩টি। ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজুকা, গোল হয় ১৭১টি। সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপের আসরে টেলস্টার ১৮, গোল হয় ১৬৯টি। আর কাতার বিশ্বকাপের খেলা অনুষ্ঠিত হয় আল-রেহলা দিয়ে, এবং আসরের সেমিফাইনাল পর্যন্ত আল-রেহলা দিয়ে গোল হয় ১৬৩টি।
হ্যাটট্রিকের তারকারা
ফিফা বিশ্বকাপ গোলের বিশ্বকাপ। আর সে আসরে কে কত গোল করেছেন কিংবা হ্যাটট্রিক গোলের মালিক কে হয়েছেন; সেসব নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে থাকে ব্যাপক উন্মাদনা। আন্তর্জাতিক ফুটবলের অভিষেক ম্যাচে একমাত্র হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটি দখল করে আছেন আর্জেন্টিনার স্ট্যাবিল। আর বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত হ্যাটট্রিকের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে। সেবার চেকস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রিয়ার এরিকবেস্ট মাত্র ২৪ মিনিটে করেছিলেন হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। ২০১৮ বিশ্বকাপের আসর পর্যন্ত ৫২টি হ্যাটট্রিক গোলের দেখা মিলেছে। সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপ আসরে স্পেনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক গোল করেছেন পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইন হ্যাটট্রিক গোল করেছেন পানামার বিপক্ষে। চলতি ২০২২ সালের বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় দেখা মিলেছে আসরের প্রথম হ্যাটট্রিকের। শেষ ষোলোর ওই ম্যাচে পর্তুগালের গনসালো রামোস-ই হয়েছেন ২০২২ বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক গোলদাতা। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে রামোস তিনটি গোল করে এই রেকর্ডে নাম লেখান। বিশ্বকাপের ইতিহাসে হ্যাটট্রিকের খাতায় আরও রয়েছে অনেক রথী-মহারথীর নাম। বার্ট প্যাটেনাইডে, গুইলার্মো স্ট্যাবিল, পেলে, পাওলা রসি, স্যান্ডোর ককসিস, জাস্ট ফন্টেইন, জিওফ হাস্ট, গ্যারি লিনেকার, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, গার্ড মুলার, রুমেনিগ, ওলেগা সালেকা, জোসেফ হিউজি, ইগোর বেনালভ, আর্নেস্ট উইলিমোস্কি, জিওএফ হাস্ট, এরিক প্রোবস্ট, ল্যাজলো কিউস, টমাস স্কুরাভি, মিরোস্লাভ ক্লোসা, গঞ্জালো হিগুইন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং হ্যারি কেইন।
কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ : ব্যতিক্রমী এক বিশ্বকাপ
পেলে-ম্যারাডোনাবিহীন প্রথম বিশ্বকাপ
ফুটবলের আলোচনা হলেই আসে কিংবদন্তি পেলে ও দিয়েগো ম্যারাডোনার নাম। তারা ফুটবলকে মানুষের কাছে রোমাঞ্চকর করেছেন। প্রতিটি বিশ্বকাপেই এ দুই কিংবদন্তির পদচারণে মুখরিত ছিল। তবে কাতার বিশ্বকাপ হলো ব্যতিক্রমী। দুজনের কেউই নেই এবারের বিশ্বকাপে। দিয়েগো ম্যারাডোনা মৃত্যু নামক সত্যের প্রাচীর পেরিয়ে দুনিয়ার সব হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন বছর দুয়েক আগে। আর কিংবদন্তি পেলে নানা রোগের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করে চলছেন হাসপাতালে।
শীতকালে প্রথম বিশ্বকাপ
ফিফা বিশ্বকাপের আগের সব আসরই অনুষ্ঠিত হয়েছিল জুন-জুলাইয়ে। নজিরবিহীনভাবে এবার সেটা পাল্টে গেছে। ফুটবলের সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা এবারই প্রথম নভেম্বর-ডিসেম্বরে আয়োজন করে বিশ্বকাপ। মূলত কাতারের তপ্ত জলবায়ুর কারণেই এবারের আসর শীত মৌসুমে সরিয়ে আনা হয়েছে। জুনে কখনো কখনো মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ফিফা। যার সুফল দেখা গেছে আসরের ম্যাচে। ফুটবলারদের খেলায় কোনো অসুবিধা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম বিশ্বকাপ
শেষ হতে চলেছে কাতার বিশ্বকাপ আসর। এবারই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বকাপ। কাতারই মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ, যারা ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, আরব বিশ্বেও কাতার প্রথম। প্রায় ১২ বছর আগে বিশ্বকাপের মতো বৃহৎ আসর আয়োজনের স্বত্ব লাভ করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। এশিয়ায় অবশ্য এটি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। প্রথমবার হয়েছিল ২০০২ সালে, যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে। এবারই শেষবারের মতো ৫টি কনফেডারেশনের ৩২টি দল বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে। ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার যৌথ আয়োজনে বিশ্বকাপে অংশ নেবে ৪৮টি দল।
প্রথম নারী রেফারি
কাতার বিশ্বকাপ-২০২২ এর আসরেই প্রথম ছেলেদের বিশ্বকাপে নারী রেফারি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। ফিফা বিশ্বকাপের ২২তম আসরে ইতিহাস গড়েছেন ছয়জন নারী রেফারি। ৬৪টি ম্যাচের জন্য মোট ৩৬ জন প্রধান রেফারির নাম ঘোষণা করেছে ফিফা। তার মধ্যে নারী তিনজন। ছেলেদের বিশ্বকাপে রেফারিং করতে যাওয়া এই রেফারিরা হচ্ছেন জাপানের ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা, ফ্রান্সের স্টিফানি ফ্রাপার্ট, রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা। এ তিনজনের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্রাজিলের নিউজা বেক, মেক্সিকোর কারেন ডিয়াজ মেদিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন নেসবিত।
প্রযুক্তির বিস্ময়
কাতার বিশ্বকাপে এবার দেখা গেছে প্রযুক্তির নানা ব্যবহার। ফিফা এবারই প্রথম ব্যবহার করেছে অ্যাডিডাসের তৈরি বল ‘আল রিহলা’। বাংলায় যার অর্থ ‘ভ্রমণ’। চামড়ায় তৈরি বলটিতে আছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। বলের নিখুঁত গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য এর ভিতরে ৫০০ হার্জ আইএমইউ সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত নিখুঁত তথ্য দিয়ে এসেছে। এছাড়াও সাইডলাইন রেফারির অফসাইড সিদ্ধান্তকে আরও বেশি দ্রুত ও যথার্থ করার লক্ষ্যে এবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে সেমি-অটোমেটেড অফসাইড পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আর তাতেই বেড়েছে ম্যাচের স্বচ্ছতা।
বিশ্বকাপে ইতিহাস কাঁপানো ঘটনাপ্রবাহ
বাছাই পর্ববিহীন বিশ্বকাপ
১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে কোনো বাছাই পর্ব ছিল না। ফিফা প্রায় সব দেশকেই সেখানে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয় মাত্র ১৩টি দেশ। অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে উরুগুয়েতে যাওয়া এড়াতে সেই বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখায়নি গোটা ইউরোপ। পরে ফিফা সভাপতি জুলেরিমের হস্তক্ষেপে এন্ট্রি দেওয়ার শেষ দিনে বিশ্বকাপে নাম লেখায় ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুগোস্লাভিয়া ও রোমানিয়া।
বল নিয়ে ঝগড়া
১৯৩০ সালের ৩০ জুলাই। উরুগুয়ের এস্তাদিও সেন্টারিও স্টেডিয়াম। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। সে সময় বিশ্বকাপে ‘অফিশিয়াল বল’ বলে কিছু ছিল না। তবে খেলা শুরুর আগে বাধল ছোট এক ঝামেলা। ফাইনাল খেলার ম্যাচে বলটি কারা সরবরাহ করবে? ফাইনালে দুই দলই দুটি বল মাঠে নিয়ে এসে আশা করে বসেছিল, রেফারি তাদের বলটি দিয়েই ফাইনাল খেলাবেন। দুই দলই বিপক্ষ দলের বল দিয়ে খেলতে নারাজ। এ নিয়ে ম্যাচ শুরুর আগে রীতিমতো ঝগড়াই বেধে যায়। শেষমেশ ফিফা কমিটি তাতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলো। তারা সমাধান দিল, প্রথমার্ধ অনুষ্ঠিত হয় আর্জেন্টিনার সরবরাহকৃত বল এবং দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের।
শাসক যখন রেফারি নির্বাচক
বিশ্বকাপে অসংখ্য কলঙ্কিত ঘটনা রচিত হয়। যার মধ্যে অন্যতম ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ। সেবার বিশ্বকাপ আসরের আয়োজক দেশ ছিল ইতালি। যা ছিল ফিফার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- দেশটিতে তখন চলছিল স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসন। মুসোলিনির কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বকাপে নানা বিতর্ক ডালপালা মেলে। কথিত আছে, ইতালির শাসক নাকি বিশ্বকাপে ইতালির ম্যাচগুলোর রেফারি নিজে নির্বাচিত করতেন। অনেকেই বলেন, তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণেই ইতালি সে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। আর সে কারণেই ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে রয়েছে অনেক সংশয়ও।
বিশ্বকাপে ভারতের অনীহা
১৯৩৮ সালের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্বকাপ মাঠে গড়াতে পারেনি ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে। ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে অংশ নেয় ১৬টি দল। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ভারত। কিন্তু সে সময় অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএ) সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। অনেকেই বলেন, ভারত নাকি বিশ্বকাপে খালি পায়ে খেলতে চেয়েছিল! ফিফা সেটি দেয়নি বলেই ভারত দল পাঠায়নি। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে, এআইএফএ বিশ্বকাপের চেয়ে অলিম্পিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তা ছাড়া ব্রাজিল যাওয়ার খরচও একটা বড় কারণ ছিল।
চিলির ‘ব্যাটল অব সান্তিয়াগো’
১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ; সেবার মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিক চিলি ও ইতালি। ম্যাচটিতে সংঘর্ষের ঘটনা এত বেশি ছিল যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের খেতাব লাভ করে। সূত্রপাত মাঠের ভিতরে নয়, বাইরে। দুই ইতালিয়ান সাংবাদিক তাদের সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন’ ‘চিলিকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়াটা পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। এখানে ফোন কাজ করে না, রয়েছে পর্যাপ্ত ট্যাক্সির অভাব। এক শহরের ভিতর একটি চিঠি পৌঁছাতে সময় লাগে পাঁচ দিন।’ এমন খবর দেখে গোটা চিলির জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্ষোভ এতটাই চরমে পৌঁছায় যে, ইতালির সাংবাদিক ভেবে আর্জেন্টিনার এক সাংবাদিককে তারা পিটিয়ে আহত করে। ঘটনা ইতালিয়ান শিবিরে পৌঁছালে খেলা শুরুর ১২ সেকেন্ডের মধ্যেই ইতালির জর্জিও ফেরেনি ফাউল করেন। ১২ মিনিটে ফেরেনি আবার ফাউল করলে রেফারি অ্যাস্টন তাকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি রেফারিকে পাত্তা না দিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে পুলিশ ঢুকে তাকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়। সমস্যা এখানে শেষ নয়, চলেছে শেষ পর্যন্ত। কী না হয়েছে? লাথি, কিল, ঘুসি, যাচ্ছেতাই রকমের ফাউল, রেফারিকে হুমকি। শেষ পর্যন্ত চিলি ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতলেও তাদের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ম্যাচ শেষে হাসপাতালে ভর্তি হন।
বিশ্বকাপ চুরির ইতিহাস
প্রথমবার : ১৯৬৬ সাল, ফিফা বিশ্বকাপের বাকি মাত্র চার মাস! ওয়েস্ট মিনস্টারের সেন্ট্রাল হলে ২৪ ঘণ্টার কড়া পাহারার পরও ২০ মার্চ, ১৯৬৬ সালে জুলে রিমে কাপ চুরি হয়ে যায়, যা সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। লন্ডনের পুলিশ বাহিনী চোরের খোঁজে ১৫ হাজার পাউন্ড পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল। ট্রফি উদ্ধার করা যাবে না, এই ভয়ে ব্রিটিশরা তড়িঘড়ি করে রেপ্লিকা কাপ তৈরির ব্যবস্থা করে। পিকেলস নামের একটি কুকুর সেবার ইংল্যান্ডের মান-ইজ্জত বাঁচায়। চুরির এক সপ্তাহ পর পিকেলস লন্ডনের একটি বাগান থেকে ট্রফিটি উদ্ধার করে।
দ্বিতীয়বার : ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতলে ট্রফিটি স্থায়ীভাবে তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ট্রফিটি আগলে রাখতে ব্যর্থ হয় ব্রাজিল। ১৯৮৩ সালে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের অফিস থেকে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায়। রিও ডি জেনেরিওতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের অফিসে ছিল জুলে রিমে ট্রফি। ভবনটির তৃতীয় তলায় ছিল ট্রফিটি। ১৯-২০ ডিসেম্বর রাতের বেলায় ভবনটিতে প্রবেশ করে বুলেটপ্রুফ কাচে ঘেরা শোকেসে রাখা ট্রফিটি নিয়ে মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায় চোরের দল। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম মূল্যবান ট্রফি। চুরির জন্য চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও কাপটি আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিশ্বকাপে নাৎসি থাবা
ফ্রান্সে ১৯৩৮ সালে তৃতীয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে। সেবার প্রবর্তিত বাছাই পর্ব পেরিয়ে মূল পর্বে সুযোগ করে নিলেও অস্ট্রিয়া বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি এডলফ হিটলারের দখলদারির কারণে। বিশ্বকাপের আগেই অস্ট্রিয়া দখল করে নেয় নাৎসি জার্মানি। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে কালো শার্ট পরে আর ম্যাচ শুরুর আগে ফ্যাসিস্ট স্যালুট দিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে ইতালি দল। কালো শার্ট তখন ছিল ইতালির ফ্যাসিস্ট প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রতীক। যথারীতি সেবারও ট্রফি ঘরে তোলে মুসোলিনির ইতালি।
এক খেলোয়াড়ের তিন হলুদকার্ড
২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার ম্যাচে বড় বিতর্কের জন্ম দেন রেফারি গ্রাহাম পুল। ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় জসিপ সিমুনিকে তিনি পর পর দুবার কার্ড দেখালেও তাকে লালকার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাননি। কারণ তিনি প্রথমবার জসিপ সিমুনিকে যে হলুদকার্ডটি দেখিয়েছিলেন সেটা ভুলক্রমে একজন অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়ের নামে লিপিবদ্ধ করেন। ম্যাচে রেফারির মতের বিরোধিতার কারণে জসিপ সিমুনিকে তৃতীয়বারের মতো রেফারি গ্রাহাম পুল হলুদকার্ড দিয়ে মাঠছাড়া করেন।
ব্রাজিলের ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’
ব্রাজিলের বিখ্যাত নাট্যকার নেলসন রদ্রিগেজের বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘সবসময় অপরিবর্তনীয় কিছু বিপর্যয় ঘটে যায়। এর মধ্যে রয়েছে হিরোশিমার মতো কিছু। আমাদের হিরোশিমা-১৯৫০ সালে উরুগুয়ের কাছে ফাইনালে হেরে যাওয়া।’ ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ জিতে উরুগুয়ে। স্বাগতিকদের হারিয়ে সুয়ারেজ-ফোরলানরা জিতে ছিলেন বিশ্বকাপ ট্রফি। সেবার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। ম্যাচটি ড্র করলেই শিরোপা নিশ্চিত হতো ব্রাজিলের। বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিল এতটাই আশাবাদী ছিল যে, ফাইনালের দিন ব্রাজিলীয় দৈনিক ‘ও মুন্দো’ ব্রাজিল দলের একটা ছবি ছাপিয়ে শিরোনাম দিয়েছিল, ‘এরাই হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!’ এই পত্রিকার অনেকগুলো সংখ্যা কিনে উরুগুয়ে অধিনায়ক ওবদুলিও ভ্যারেলা নিজেদের হোটেল রুমের টয়লেটে নিয়ে ফেলেছিলেন। সতীর্থদের বলেছিলেন পত্রিকাগুলোর কপিতে প্রস্রাব করতে! দলের আত্মবিশ্বাস তুলে ধরতেই ভ্যারেলা এমন বলেন। ফাইনালে লাখো দর্শকের সামনে এই উরুগুয়ে ২-১ গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে উৎসব করে। ব্রাজিলিয়ানরা এ ঘটনায় এতটাই মুষড়ে পড়েছিল যে, ফাইনালের পর মারাকানা স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দর্শকদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। যা আজও ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত।