শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিখ্যাতদের বাড়ি এখন...

বিখ্যাতদের বাড়ি এখন...

বাংলাদেশেই জন্মভিটা উপমহাদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তির। রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা, সংগীত নানা ক্ষেত্রে তারা ছিলেন বিশ্ববরেণ্য। কিন্তু অবহেলা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে বিখ্যাতদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। সেই খবরই তুলে এনেছেন প্রতিনিধিরা-

 

জ্যোতি বসুর বাড়িতে গ্রন্থাগার

মো. আল-আমিন সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)

ইতিহাসের এক মহানায়কের নাম কমরেড জ্যোতি বসু। তিনি ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বাম ফ্রন্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এই কিংবন্দির শৈশব কেটেছে বাংলাদেশে। তার পৈতৃক ভিটা নরায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে। বাংলাদেশে এলেই ছুটে যান বারদীতে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে ঢাকায় আসেন জ্যোতি বসু। ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই মানুষটি শৈশবে সোনারগাঁয়ে অনেক দিন কাটিয়েছেন। ১৯৮৭ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি পৈতৃক বাড়িতে আসেন।

১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৪ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বারবার নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হয়েছিল। এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রিত্ব করার পর তিনি এই দায়িত্বটি তুলে দেন তারই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। ২০১০ সালে জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর তার স্মৃতি ধরে রাখতে পৈতৃক বাড়ি সোনারগাঁয়ের বারদীতে একটি গ্রন্থাগার করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্রন্থাগারের নির্মাণকাজ শুরু করে। যার প্রথম তলায় রয়েছে পাঠাগার কক্ষ, মহাফেজখানা ও শৌচাগার। দ্বিতীয় তলায় জাদুঘর ও সেমিনার হল।

২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতি বসু স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

২ একর ৪ শতক বাড়িটির মধ্যে রয়েছে ৮৮ বছরের পুরনো একটি দ্বিতল ভবন। বাড়িতে একটি পুকুর ও একটি কুয়াও রয়েছে। বর্তমান সরকার জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করে। ১৩২৯ বাংলা সনের ১৩ অগ্রহায়ণ পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। ভবনটির নিচতলায় রয়েছে দুটি শয়ন কক্ষ ও একটি বৈঠকখানা। দ্বিতীয়তলায়ও রয়েছে দুটি শয়ন কক্ষ। রয়েছে একটি ব্যালকনি। বাড়িটির দেখাশোনার জন্য ফকির মাহমুদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

অবৈধ দখলে বীরকন্যা প্রীতিলতার পৈতৃক বাড়ি

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রদূত বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পৈতৃক বাড়ি দখল করে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। শুধু দখল নয়, প্রীতিলতার বাড়ির সব স্মৃতিও ধ্বংস করছে তারা। প্রীতিলতার এ বসত বাড়ি উদ্ধারের জন্য প্রশাসন ও প্রীতিলতা ট্রাস্ট নানান উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, কয়েক মাস আগে প্রীতিলতার পৈতৃক বাড়ি পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শন করে অবৈধ দখলে থাকা বাড়িটি উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে থানা পুলিশকে নির্দেশ নিয়েছে। পটিয়া ধলঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রণবীর ঘোষ বলেন, ‘প্রীতিলতার পৈতৃক বাড়ি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এরই মধ্যে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে প্রীতিলতা ও তার পরিবারের নানান স্মৃতি। দখলদারদের উচ্ছেদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

প্রীতিলতা ট্রাস্টের আজীবন সদস্য প্রবোধ চন্দ্র রায় জানান, পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নে প্রীতিলতার পৈতৃক ৫০ শতকের অধিক জমি রয়েছে। অবৈধ দখলের পর স্থানীয় লোকজন উদ্ধারের চেষ্টা করলেও অবৈধ দখলকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ওই জায়গা মুক্ত করতে পারেনি। যারা এসব জমি দখল করে আছে তারা প্রীতিলতার কোনো আত্মীয় স্বজন নয়। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কারা এসব জমি দখল করে রেখেছে এবং প্রীতিলতার স্মৃতি ধ্বংস করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান কাগজপত্র নিয়ে ইউনিয়ন অফিসে যেতে বলেছেন। কিন্তু তাতেও তারা কর্ণপাত করছেন না।

পটিয়া উপজেলার গণমাধ্যম কর্মী আবেদ আমেরী বলেন, বীরকন্যা প্রীতিলতার পৈতৃক বাড়ি অবৈধ দখল ও স্মৃতি ধ্বংসের বিষয়টা দুঃখজনক। প্রীতিলতার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে উদ্ধার করে সংরক্ষণের দাবি করছি।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রদূত প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালে ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নে। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। ইউরোপিয়ান ক্লাব সফল অভিযানের পর ফিরে আসার সময় হঠাৎ গুলিতে আহত হন প্রীতিলতা। এরপর ধরা পড়ার আশঙ্কায় পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত সবই বিস্মৃতি

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরের শিবপুর গ্রাম। এ গ্রামেই বিশ্ব বরেণ্য সংগীতজ্ঞ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি জন্ম ভূমি। ১৮৬২ সালে এ গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। দুনিয়াজুড়ে যার যশ খ্যাতি বিরাজমান সেই সুরসম্রাটের বাড়িতে গেলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। ভাঙাচোরা-বাড়িঘর। আলাউদ্দিন খাঁর বসত ভিটার পাশেই নিজ নামে কলেজ। একটু দূরেই তার নিজ হাতে গড়া সুদৃশ্য মসজিদ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পিতা সবদর হোসেন খাঁ এবং মাতা সুন্দরী খানমের কবর দুটির চারদিকের সীমানা প্রাচীর ভেঙে গেছে। মূল কবরস্থানটিও পার্শ্ববর্তী পুকুরে বিলীনের পথে। ১৯১৯ সালে ওস্তাদজী কর্তৃক নির্মিত হয় সুদৃশ্য একটি মসজিদ। মসজিদটিতে ছোট-বড় ১৬টি মিনার আছে। মসজিদের পেছনে ঈদের নামাজের জন্য বড় একটি পাকা মাঠ তৈরি করা হয়। ওস্তাদ নিজ হাতে মাটি কেটে ফেলে ইট বসিয়ে যে মসজিদটি তৈরির সূচনা করেছিলেন তা আজ সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের পথে। ১৯১৮ সালে আলাউদ্দিন খাঁ মাইহারের রাজ দরবারে সংগীত গুরুর আসন লাভ করেন। বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন ১৯৩৫ সালে। তখন তিনি ইংল্যান্ডের রানী কর্তৃক সুরসম্রাট খেতাব প্রাপ্ত হন। নবীনগরের মানুষের কাছে সুরসম্রাটের বাড়ির ভিন্ন নামে পরিচিত। বহুকাল থেকেই বাড়িটিকে এলাকার মানুষ ‘বাজাইন্যা বাড়ি’ (বাজনাওলাদের বাড়ি) ‘বাদ্যকার পাড়া’ বলে ডেকে আসছে। ইতিহাস বলছে, প্রায় ১২ বছরেরও ওপর সংগীত সাধনা করেন তিনি। দীর্ঘ সংগীত সাধনা শেষে বাড়ি ফিরে আলাউদ্দিন খাঁ শুরু করেছিলেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মায়ের আদেশে বিভিন্ন এলাকায় গান করে গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ ও একটি পুকুর খনন করেছিলেন। সুরসম্রাটের গড়া সেই মসজিদ ও পুকুরটি আজও তার স্মৃতি বহন করছে। এ দুটির বয়স এখন প্রায় ১১০ বছর। ব্রিটিশ সরকার তাকে খাঁ সাহেব উপাধিতে সম্মানিত করে। ‘চন্দ্রসাগর’ নামের একটি বাদ্যযন্ত্রের তিনি উদ্ভাবক। মদন-মঞ্জুরী, হেম-বসন্ত, হেম-বেহাগ, প্রভাত-কেলি, মেঘ-বাহার, দুর্গেশ্বরী ও হেমন্ত সুরসম্রাটের রাগ-রাগিণীর মধ্যে অন্যতম। শিবপুরে সুরসম্রাটের বংশধর ফকির আফতার উদ্দিন খাঁর মেয়ের সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন ৯০ বছর বয়স্ক তোতা খাঁ ও সুধা খাঁ। সুধা খাঁর বড় সন্তান ছমিরউদ্দিন খাঁর ছেলে মতিলাল খাঁ, তার ছেলে লাখু খাঁর পরিবারের লোকজন বর্তমানে ভিটে মাটিতে অবস্থান করছেন। অবশ্য কয়েক বছর পূর্বে ওস্তাদজীর দৌহিত্র লাখু খাঁ ইন্তেকাল করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে সংগীত বিদ্যালয়, পর্যটন কেন্দ্র, অতিথিশালা ও মিলনায়তন গড়ে তোলার জন্য ১৯৯১ সালে জেলা প্রশাসকের কাছে ২২.৫০ শতাংশ জায়গা হস্তান্তর করেন। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিবারের মধ্যে এ বাড়িতে এখন সংগীতে তালিম দেওয়া-নেওয়ার কেউ নেই। যারা আছেন তারা ঢাকা কেন্দ্রিক। গ্রামে কেউ বাড়িঘর করে না। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সভাপতি রানা শামীম রতন জানান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বসত বাড়ির অধিকাংশ জায়গা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দখল হয়ে গেছে।

পর্যটকদের আগ্রহবিন্দু সুচিত্রার বাড়ি

এস এ আসাদ, পাবনা

বাংলা চলচ্চিত্রের তথা উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পাবনার পৈতৃক বাড়িটি বর্তমানে ‘কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। স্বাধীনতাবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের কবল থেকে হাই কোর্টের নির্দেশ ও পাবনাবাসীর প্রাণের দাবিতে দখলমুক্ত করা হয়। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানাতে ও তার স্মৃতি রক্ষার্থে পাবনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা সংগ্রহশালায় মহানায়িকার বিভিন্ন ছবি, জীবনের বিভিন্ন তথ্য সংবলিত বিলবোর্ড, পুস্তিকা, সিনেমার পোস্টারসহ রয়েছে নানা নিদর্শন। বাড়ির আঙ্গিনায় সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে সুচিত্রার একটি ম্যুরাল। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই  চোখে পড়ে সুচিত্রার বিশালাকৃতির এ প্রতিকৃতি। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন সব ফুলের গাছ। বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে আছে মহানায়িকার স্মৃতি। আর তাতে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। সুচিত্রার পৈতৃক এ বাড়িটিকে পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভে পরিণত করার ইচ্ছে রয়েছে প্রশাসনের। সংগ্রহশালায় তথ্য ও ছবিতে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তার বাড়িতে ঘুরতে আসেন। সংগ্রহশালা দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী নুরুজ্জামান বলেন, ‘সোমবার সপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিন ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালাটি।  দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শনার্থী ছাড়াও কলকাতাসহ দেশ বিদেশ থেকে প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসেন। তারা সংগ্রহশালাটি দেখে মুগ্ধ ও আনন্দিত হন।

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল এই বাড়িতেই জন্ম গ্রহণ করেন কৃষ্ণা অর্থাৎ সুচিত্র সেন। এই পাবনাতেই কেটেছে তার শৈশর ও কৌশর। মতান্তরে তিনি তার নানা বাড়ি তৎকালীন পাবনা জেলার বেলকুচি উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি গ্রামের সেনভাঙ্গার জমিদার বাড়িতে তার জন্ম হয়। সুচিত্রা সেন তার বাবা মা, এক ভাই ও তিন বোনকে সঙ্গে নিয়ে শৈশব-কৈশর কেটেছে পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের বাড়িতে। পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়া কালীন সময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সপরিবারে ওপার বাংলায় পাড়ি জমান। তার বাবা করুণাময় দাশ গুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর।

যেভাবে বাড়িটি দখল করা হয় : ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তার বাবা সপরিবারে ভারত চলে যান। পরে সুকৌশলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বর্তমান নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত করে ইমাম গাজ্জালি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাড়িটি দখলের চেষ্টা চালান। অবশ্য পাবনাবাসী বাড়িটি উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করলে কর্তৃপক্ষ তাদের লিজ বাতিল করে।  ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই আদালত রায় দিলে তার দুই দিন পরে জেলা প্রশাসন দখলকারীদের উচ্ছেদ করে দখলে নেয়। পাবনাবাসীর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সুচিত্রা  সেন। বাড়িটি আরও সমৃদ্ধশালী করার পাশাপাশি পাবনার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কিংবা ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে তুললে তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট সাক্ষী হয়ে থাকবে বলে মনে করেন পাবনাবাসী।

জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটা আজও উদ্ধার হলো না

রাহাত খান, বরিশাল

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির দেড় যুগ পরও কবি জীবনানন্দ দাশের বরিশালের পৈতৃক বাড়ি পুনরুদ্ধার হয়নি। বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের (পরবর্তীতে কবি জীবনানন্দ দাশ সড়ক নামকরণ হয়) মুন্সির গ্রেজ এলাকায় কবির স্মৃতিবিজড়িত প্রায় সাড়ে ৬ বিঘা আয়তনের বাড়িটি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে নেই কবির পূর্ব পুরুষদের লাগানো শাল, শিরিশ, আম, জাম, কেওড়া ও ঝাড় গাছ। নেই জীবনানন্দ দাশের সাধের গোলাপ বাগানও। কবির পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিবাহী মঠগুলোরও অস্তিত্ব নেই। এখন তার পৈতৃক ভিটায় বসবাস করছে ৪টি পরিবার। এ ছাড়া ওই জমিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের একটি বাসভবন (কোয়ার্টার) ছাড়াও রয়েছে সিটি করপোরেশনের পাম্প হাউস এবং জেলা পরিষদ নির্মিত একটি পাঠাগার ও লাইব্রেরি। অথচ ১৯৯৯ সালের ২৭ এপ্রিল বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে কবি জীবনানন্দ দাশের বরিশালের বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানালে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) কবির বাড়ি সংরক্ষণের আশ্বাস দেন। বাড়ির বর্তমান বাসিন্দারা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে কবির বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তখন সংস্কৃতি সচিব কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি সংরক্ষণে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার হয়নি নৈসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি। কবির পূর্ব পুরুষরা থাকতেন তৎকালীন ঢাকার বিক্রমপুরে। পদ্মার ভাঙনে বিক্রমপুরের ওই বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বরিশাল শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে জীবনানন্দ দাশের জন্ম। তার বাবা সর্বানন্দ দাশ গুপ্ত বরিশালের কালেক্টরেটের একজন কর্মচারী ছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি বগুড়া রোডে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে ভারতে চলে যান। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি আর এই বাড়িতে ফিরে আসেননি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তার পিসি স্নেহলতা দাশও বাড়িটি ছেড়ে কলকাতা চলে যান। ১৯৬০ সালের ১৭ জুন ওই বাড়ি সরকারিভাবে নিলামে ক্রয় করেন তৎকালীন কালেক্টরেট কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক। বর্তমানে আবদুর রাজ্জাকের উত্তরসূরি ৪টি পরিবার ওই বাড়িতে বসবাস করছেন। পরে সরকার ওই বাড়ির প্রায় অর্ধেক জমি হুকুম দখল (অধিগ্রহণ) করে। যার ক্ষতিপূরণও পায় আবদুর রাজ্জাকের পরিবার। অধিগ্রহণ করা জমিতে গড়ে ওঠে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীদের বাসভবন। একাংশে গড়ে ওঠে সিটি করপোরেশনের পাম্প হাউস এবং ২০১০ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত হয় কবি জীবনানন্দ দাশ মিলনায়তন ও পাঠাগার। বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জানান, কবি জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটা পুনরুদ্ধারে ইতিমধ্যেই তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন।

শচীন দেব বর্মণের বাড়ি কবে হবে জাদুঘর

মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি সংস্কারের পর জাদুঘর চালু করার কথা থাকলেও তা এক বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। এটি পুনরায় পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিণত হচ্ছে। বাড়িটি চালু রেখে শচীনের কীর্তি মানুষকে জানানোর দাবি সংস্কৃতিকর্মীদের। সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণ ১৯০৫ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা মহানগরীর দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার রাজপরিবারের সন্তান সংগীতশিল্পী নবদ্বীপ চন্দ্র দেব। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি সপরিবারে কুমিল্লা চলে আসেন। পরে তাদের বাড়ির জমি দিয়েছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছা। শচীন দেবের পড়াশোনা প্রথমে কুমিল্লা ইউছুফ স্কুলে। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ছেলে শচীন যে জগদ্বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ হবেন তা তার বাবা আগেই বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কুমিল্লার গুণী উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী শ্যামাচরণ দত্তকে ছেলের শিক্ষক নির্বাচিত করেন। কুমিল্লায় কবি নজরুলের সঙ্গে শচীনের পরিচয় হয়। মাঝে-মধ্যে কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মণের বাসায়, কখনো দারোগাবাড়ি, জানু মিয়া চৌধুরীর বাড়ি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাসায়ও বসত গানের জলসা। শচীন দেব বর্মণ ১৯ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। ১৯৪৪ সালে তিনি মুম্বাই চলে যান। মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের মর্যাদা লাভ করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, শচীন দেবের বাড়িটি ২০১৭ সালে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কিছু করা হয়নি। ৩১ অক্টোবর এখানে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বাকি সময় এটি পরিত্যক্ত বাড়ির মতো পড়ে থাকে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, শচীন দেবের বাড়িতে জাদুঘর করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, কিছু লোকবল নিয়োগ দিয়ে জাদুঘর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করব।

 

মধুকবির জন্মভিটায় পর্যটকদের ভিড়

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

বাংলায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটা অনেকদিন ধরেই পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’-এর এই স্রষ্টা ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের নামকরা উকিল ছিলেন। এ রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথম স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন। তার শৈশব ও কিশোর সাগরদাঁড়িতে কাটলেও মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তাকে কলকাতায় চলে যেতে হয়। এরপর আর কখনই তিনি সাগরদাঁড়িতে ফেরেননি। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, বিয়ের পর তিনি একবার সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ায় স্বজনরা তাকে বাড়িতে উঠতে দেননি।

যশোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাগরদাঁড়ির জন্মভিটা এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বাড়িটি সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়। কুটিরের আদলে এটি নির্মাণ করা হয়। তৈরি করা হয় দুটি অভ্যর্থনা স্থাপনা ও একটি মঞ্চ। মূল বাড়ির ভিতরের অংশে আছে একটি দুর্গম পথ। যেখানে প্রতি বছর নিয়মিত দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। কবির স্মৃতি ও আলোকচিত্র নিয়ে জাদুঘর করা হয়েছে। দোতলা বাড়িটিতে ওপরে তিনটি ও নিচে তিনটি কক্ষ রয়েছে। নিচতলায় কবির পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, আলমারিসহ নানা জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা আছে। এর পাশেই ছোট একটি পাঠাগার। ভবনটির উত্তরদিকে ছাদহীন একটি কক্ষের কোনায় সবসময় তুলসী গাছ দেখা যায়। এই কক্ষেই মহাকবি জন্মেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে।

এ কমপ্লেক্সের বাইরে দত্তবাড়ির বাঁধানো পুকুর ঘাট এবং মহাকবির শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের সেই দত্তবাড়ির ঘাট এখনো আছে। ঘাটের পাশেই আছে সেই বাদাম গাছটিও। এর পাশেই জেলা পরিষদের ডাকবাংলো এবং পিকনিক স্পট। প্রতি বছর কবির জন্মবার্ষিকীতে দত্তবাড়ির আঙিনায় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জমজমাট গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ তো বটেই, ভারত থেকেও আসেন অনেক মধুভক্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর