বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ১৯৩। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী উল্লিখিত সমুদয় দায়দায়িত্ব যারা গ্রহণ করবে এবং এর বিচারে যারা এসব দায়দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম ও ইচ্ছুক সেভাবে অন্য সব শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকবে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার নীতির ওপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সব মানুষের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
স্বাধীন জাতির সর্ববৃহৎ সংগঠন
বর্তমান বিশ্বের স্বাধীন জাতিসমূহের সর্ববৃহৎ সংগঠনের নাম জাতিসংঘ। এটি মূলত একটি রাজনৈতিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন, তবে অধি-রাষ্ট্রিক বা কোনো বিশ্ব সরকার নয়। ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শান্তি এবং নিরাপত্তা’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে ‘লীগ অব নেশন্স’ বা ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরুতে লীগ অব নেশন্সের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হলেও ১৯৩০ সালের পর থেকে জার্মানি, ইতালি এবং জাপানের মতো অক্ষশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। ফলে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, লীগ অব নেশন্স বিশ্বের শান্তি রক্ষার প্রধান লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। তবে লীগ অব নেশন্স ব্যর্থ হলেও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতারা এর ধারণা থেকে উদ্বুদ্ধ হন। তারপর জাতিসংঘের ধারণা প্রথম সূচনা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি সম্পাদিত ‘সম্মিলিত জাতিসমূহের ঘোষণার’ মাধ্যমে জাতিসংঘ শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। যেখানে ২৬টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মতো অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন সানফ্রানসিস্কোতে আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে ‘জাতিসমূহের সম্মেলনে’ ৫০টি দেশের প্রতিনিধি জাতিসংঘ সনদ রচনা করেন। ১৯৪৪ সালের আগস্ট-অক্টোবরে ওয়াশিংটনের ডাম্বার্টন ওকসের বৈঠকে চীন, ফ্রান্স সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে এ সনদ গড়ে ওঠে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ৫০টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন সনদটি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করেন। পোল্যান্ড সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও পরে এতে স্বাক্ষর প্রদান করে প্রথম স্বাক্ষরকারী ৫১টি রাষ্ট্রের একটিতে পরিণত হয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর চীন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও স্বাক্ষরকারী অধিকাংশ দেশের সনদ অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর বিশ্বের সব স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে জাতিসংঘ দিবস উদযাপিত হয়। সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৪৮ সালে এ দিবস পালনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ১৯৩টি। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী উল্লিখিত সমুদয় দায়দায়িত্ব যারা গ্রহণ করবে এবং এর বিচারে যারা এসব দায়দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম ও ইচ্ছুক সেভাবে অন্য সব শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকবে (সনদের অনুচ্ছেদ নম্বর-৪)। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলোÑ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার নীতির ওপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সব মানুষের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। আন্তর্জাতিক সংকট মুহূর্তে এ সংগঠন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে ভারসাম্য বজায় রাখে। শান্তিরক্ষা, শান্তি সৃষ্টি, সংকট প্রতিরোধ এবং মানবীয় সাহায্যের জন্য জাতিসংঘ বেশি পরিচিত। তবে এ দিকগুলোর বাইরেও বিভিন্ন উপায়ে জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গসংস্থাগুলো (বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা, ফান্ড এবং কর্মসূচি) বিশ্বকে প্রাবিত করে। এ সংগঠন বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন মৌলিক ইস্যু, যেমন টেকসই উন্নয়নের ধারণা থেকে শুরু করে পরিবেশ এবং শরণার্থীদের রক্ষণ, দুর্যোগ সহায়তা, সন্ত্রাসবাদ দমন, নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, ভূমি মাইন অপসারণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য পূরণে কাজ করে থাকে।
অঙ্গসংগঠন
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের হিসাব অনুযায়ী জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩টি। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গসংস্থাগুলো হলো - সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নানারকম সমস্যার সমাধান, সুবিধা বৃদ্ধি, উন্নত জীবনমান গঠন এবং নিরাপত্তা দানে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে। জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এগুলোর মহাসচিব। জাতিসংঘের আরও কিছু অঙ্গসংগঠন আছে যা বিশ্বের অনেক দেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সদস্যা রাষ্ট্র ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে নিজেদের সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। যেমন ১৯৫টি দেশে কাজ করছে ইউনেস্কো। ১৯৪টি দেশে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা UNCTAD, ১৯৪ দেশে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা WTO, ১৯৪ দেশে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন ITU, ১৯৭ দেশে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO ও ১৯২ দেশে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন UPU কাজ করে যাচ্ছে। ICAO কাজ করছে ১৯১টি দেশে, IBRD কাজ করছে ১৮৮টি দেশে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল IMF ও উইমেন ইন পার্লামেন্ট WIPO। ১৮৬টি দেশে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করছে ILO, MIGA আছে ১৮০টি দেশে, IFAD আছে ১৭৬টি দেশে, UNIDO আছে ১৭০টি দেশে, IMO আছে ১৭১টি দেশে, IAEA আছে ১৬৪টি দেশে। এর বাইরেও কাজ করছে UNCHR, UNICEF, UNIFA নামের জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন।
প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয় বছরে একবার
প্রতি বছরের মতো এবারও সেপ্টেম্বরের তৃতীয় মঙ্গলবার নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশন। ৭৪তম এ অধিবেশনে শতাধিক রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন। বিভিন্ন দেশের এত সংখ্যক নেতার সমাবেশ অন্য কোথাও ঘটে না। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয় বছরে একবার। ফলে সারা বিশ্বের নজর থাকে এ বৈঠকে কে কী বলেন সেদিকে। অধিবেশনের প্রথম সাত দিন অতিবাহিত হয় ২১ জন উপসভাপতির নির্বাচন ও বিভিন্ন পদ্ধতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে। অধিবেশনের মূল আকর্ষণ সাধারণ বিতর্ক শুরু হয় ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে। চলে দুই সপ্তাহ। বিতর্ক শুরু হওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে বসে বৈশ্বিক জলবায়ু প্রশ্নে একটি শীর্ষ বৈঠক। এবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আমন্ত্রণে এদিনে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রশ্নে আরও একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সাধারণ বিতর্ক চলাকালে আরও কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হবে। এ বিতর্কের কূটনৈতিক গুরুত্ব থাকে অনেক। সাধারণ বিতর্কের দুই সপ্তাহ অধিকাংশ বিশ্ব নেতা যার যার দেশের দর্শক-শ্রোতাদের কথা মনে রেখেই ভাষণ দেন।
নিরাপত্তা পরিষদের দেশগুলো
ঐতিহ্যগতভাবে নিরাপত্তা পরিষদ কেবল সামরিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে। এটি জাতিসংঘের এমন একটি অঙ্গ, যেখান থেকে জারি করা রেজুলেশন সদস্য দেশগুলোর জন্য মানা বাধ্যতামূলক। এ নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত ১৫ সদস্য নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী পাঁচ পরাশক্তিÑ চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এর স্থায়ী সদস্য। এ স্থায়ী সদস্যদের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন, নতুন সদস্য দেশ অন্তর্ভুক্তি বা মহাসচিব প্রার্থীর নিয়োগে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে। নিরাপত্তা পরিষদের বাকি ১০ সদস্য অস্থায়ী। তারা নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে ২ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রথম দুই দশকে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য ছিল ৬টি। নিরাপত্তা পরিষদের কাজ জাতিসংঘ সনদ দ্বারা সংজ্ঞায়িত, যা কোনো আন্তর্জাতিক শান্তির হুমকি পরিস্থিতির তদন্ত, বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পদ্ধতি সুপারিশ, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সমুদ্র, বাতাস, ডাক ও রেডিও যোগাযোগ ছিন্ন করা, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষমতা রাখে। এমনকি সামরিক আক্রমণের ক্ষমতাও রাখে।
শুভেচ্ছা দূত
শুভেচ্ছা দূত হিসেবে মূলত সম্মানীয় পদবিধারী ব্যক্তিত্ব, তারকা, বিজ্ঞানী, লেখক, ভিন্নমতাবলম্বী এবং অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের সমাজসেবকসহ জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা নিয়োগ পান। জাতিসংঘ তার সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুভেচ্ছা দূত নিয়োগ করে থাকে। এটি ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক চুক্তি কিংবা চাকরির পর্যায়ে হয়ে থাকে। জাতিসংঘ শান্তি বার্তাবাহক, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, এইচআইভি ও এইডস কর্মসূচি, পরিবেশ কার্যক্রম, ইউএনডিপি, ইউনেস্কো, ইউনোডিসি, ইউএনএফপিএ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ইউনিসেফ, ইউনিডো, ইউনিফেম, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য শুভেচ্ছা দূত হিসেবে সময়ে সময়ে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের নিয়োগ করে থাকে। তেমনিভাবে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির তারকাখ্যাতিকে উপজীব্য করে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক কমিশন তাকে সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে শুভেচ্ছা দূতের মর্যাদা দেয়। সরকারের অংশ হিসেবে তারা আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। শুভেচ্ছা দূত কূটনৈতিক কর্মকা-ে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেন, উপহারসামগ্রী বিতরণ করেন, আর্তদের জন্য পণ্যসামগ্রী বণ্টন করেন কিংবা নির্মাণসামগ্রী প্রদান করে থাকেন।
মহাসচিব
জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও ম্যানুয়েল দে অলিভেরা গুতেরেস। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সাল মেয়াদে তিনি পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি জাতিসংঘে মহাসচিবের পদে আছেন। এর আগে ২০০৫ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ছিলেন। এ ছাড়া সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাকে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি বান কি মুনের স্থলাভিষিক্ত হন। জাতিসংঘের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন মহাসচিব। জাতিসংঘ সনদের ৯৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক মহাসচিবকে ‘প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সনদে আরও বলা হয়েছে যে, মহাসচিব যে কোনো বিশ্ব শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা ও নিরাপত্তার খাতিরে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আনতে পারবেন। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মহাসচিব নিযুক্ত করে। পদের মেয়াদ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। কিন্তু আগে থেকেই এক বা দুই মেয়াদে ৫ বছরের জন্য ভৌগোলিক চক্রাবর্তে মহাসচিব পদে মনোনীত করার বিধান চলে আসছে। অ্যান্তোনিও ম্যানুয়েল দে অলিভেরা গুতেরেসের আগে আরও আটজন জাতিসংঘে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন- ট্রাইগভে লাই, নরওয়ে; ডেগ হামারশোল্ড, সুইডেন; উ থান্ট, মিয়ানমার; কুর্ট ওয়াল্ডহেইম, অস্ট্রিয়া; জ্যাভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার, পেরু; বুট্রোস বুট্রোস ঘালি, মিসর; কফি আন্নান, ঘানা ও বান কি মুন, দক্ষিণ কোরিয়া।
ভেটো বা আমি মানি না
ভেটো শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘আমি মানি না’। অবশ্যম্ভাবী শব্দ হিসেবে ভেটো শব্দটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং বৈশ্বিকভাবে এটি বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স- এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। তারা প্রত্যেকেই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। এ কারণে জাতিসংঘ পরিষদে এ দেশগুলোকে একত্রে পঞ্চশক্তিও বলা হয়। ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোনো একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে বাধা প্রদান করতে পারে। ভেটো দেওয়ার এ প্রথা চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। প্রাচীন রোমের কনসাল এবং ট্রাইবুনরা আইন সভায় তাদের ভেটো প্রদান করতে পারতেন। এর মধ্যে দুজন কনসাল নির্দিষ্ট বছরে সামরিক কিংবা বেসামরিক পর্যায়ের কোনো প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্ত বাতিলকল্পে একে অপরের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করলে রোমান সিনেটের দায়িত্বে নিয়োজিত ট্রাইবুনকর্তৃক তা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করার ক্ষমতা প্রদান করা হতো। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে কোনো বিলের ওপর তার ভেটো প্রদান করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু হাউস এবং সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ভেটো প্রদানের সক্ষমতাকে বাতিল করার ক্ষমতাও রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সরকার গঠনের পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বের জনমত ও রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায় করা। এ উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকারের একটি বিশেষ প্রতিনিধি দলকে ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে পাঠানো হয়। প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে দীর্ঘ বক্তব্য জমা দেন যা নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউনিসেফ প্রভৃতি জাতিসংঘ-সংস্থা শরণার্থীদের জন্য কাজ শুরু করে। জাতিসংঘের এ সম্পৃক্ততার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কৌশলগতভাবেও লাভবান হয়। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশ সদস্যপদপ্রাপ্তির লক্ষ্যে তৎপরতা চালায়। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর সময়ে পাকিস্তান সরকারের প্ররোচনায় নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো প্রয়োগের কারণে পর পর দুবার বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যোগদান করে। যোগদানের এক সপ্তাহ পর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলায় ভাষণ দেন।
সদর দফতর
জাতিসংঘের সদর দফতর অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। ১৯৫২ সালে নির্মাণের পর থেকে এটি জাতিসংঘের দাফতরিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন বরোর টার্টল বে এলাকায় ১৬ একর জমিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫০ সালে নির্মাণ করা হয় ভবনটি। সদর দফতর স্থাপনের জমি কেনার জন্য জন ডি রকফেলার জুনিয়র ৮.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন। তিনি জাতিসংঘকে এ জমি দান করেন। সদর দফতরের মূল ভবনটির নকশা প্রণয়ন করেন লে করবুসিয়ে, অস্কার নিয়েমেয়ারসহ আরও অনেক খ্যাতনামা স্থপতি। নেলসন রকফেলারের উপদেষ্টা ওয়ালেস কে হ্যারিসন এ স্থপতি দলের নেতৃত্ব দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সদর দফতরের উদ্বোধন হয় ১৯৫১ সালের ৯ জানুয়ারি। জাতিসংঘের তিনটি অতিরিক্ত, সহায়ক ও আঞ্চলিক সদর দফতর রয়েছে। এগুলো জেনেভা, ভিয়েনা ও নাইরোবিতে অবস্থিত। এ দফতরগুলো জাতিসংঘকে তার নির্দেশনা প্রতিনিধিত্বকরণে, কূটনৈতিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ও কিছু অতিরাষ্ট্রিক সুবিধা লাভে সাহায্য করে। তবে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতর কেবল জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গসংগঠন ধারণ করে। এ ছাড়া জাতিসংঘের ১৫টি বিশেষায়িত সংস্থার দফতর নিউইয়র্কের বাইরে অন্যান্য দেশে অবস্থিত।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের সদস্যপদপ্রাপ্তির পর থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় তার ভূমিকা রেখে চলেছে। জাতিসংঘের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র যেমন- উন্নয়ন, পরিবেশ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তিরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভের এক বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দুবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক)-এর সদস্য হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম ব্যাপক আকারে দেখা যায়। কাজের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- অর্থনীতি, বিদ্যুৎ শক্তি, পরিবেশ, জরুরি সহায়তা, শিক্ষা, দুর্যোগ, খাদ্য, জেন্ডার ইস্যু, সুশাসন, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, অভিগমন, পুষ্টি, অংশীদারিত্ব, জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, শরণার্থী, শহরায়ন, কর্মসংস্থান এবং জীবনধারণ।