বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আমেরিকার আলোচিত যত প্রেসিডেন্ট

সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমকালের পরাশক্তি দেশ আমেরিকা। খোলামেলা ভাষায় বললে, আধুনিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির প্রধান অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নিয়ন্ত্রণ করেন দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি গোটা বিশ্ব। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে বারাক ওবামা, ইতিহাস দেখেছে অনেক কিছু। আর সেসব স্মৃতিপট থেকেই মিলবে অনেক আলোচিত-সমালোচিত প্রেসিডেন্টের নাম এবং তাদের কার্যকলাপ। আমেরিকার ইতিহাসের সেই আলোচিত প্রেসিডেন্টদের নিয়ে আজকের রকমারি...

আবদুল কাদের

আমেরিকার আলোচিত যত প্রেসিডেন্ট

জর্জ ওয়াশিংটন [প্রথম প্রেসিডেন্ট]

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন

জর্জ ওয়াশিংটন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৭৩২ সালে ভার্জিনিয়ার এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া ওয়াশিংটন দুটো বিষয়ে ভীষণ উৎসাহী ছিলেন এবং সেগুলো নিয়ে চর্চা করতেন। এক. সামরিক কৌশল এবং দুই. পশ্চিমা সম্প্রসারণ। জীবনের শুরুতে ওয়াশিংটন ভূমি জরিপের কাজ করতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি শিনানডোয়াহ্ ভূমি জরিপ কাজে সাহায্য করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান ভোলার নয়। ওয়াশিংটন সেই যুদ্ধে কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব পালন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনে ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কর্মজীবনেও তিনি এতটাই সফল ছিলেন যে, জীবদ্দশা থেকে আজ অবদি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত। আদর্শ এবং সততার জন্য ওয়াশিংটন ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ইলেকটোরাল কলেজের প্রথম দুটি নির্বাচনে সর্বসম্মতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ওয়াশিংটন। পরবর্তীতে রাজনীতি নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় এবং বুড়িয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আমেরিকার ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি কিনা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অবস্থাতেও বার্ষিক ২৫ হাজার ডলার বেতন গ্রহণ করতেন না। মহান এই ব্যক্তির নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য শুধু নিজ দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে প্রশংসিত। অবসরের পর মাউন্ট ভার্ননে তিন বছর অবসর জীবন উপভোগ করেন ওয়াশিংটন। ১৭৯৯ সালে গলায় রোগসংক্রমণের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মহান প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে জাতি কয়েক মাস ধরে শোক পালন করে।

 

অ্যান্ড্রু জ্যাকসন [সপ্তম প্রেসিডেন্ট]

প্রথম ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে গাধা প্রতীক নিয়ে লড়াই করেন জ্যাকসন। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে তিনিই প্রথম কাজ করেন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ১৮২৮ সাল থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার হাত ধরে গড়ে ওঠে মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। প্রথম ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন প্রথম গাধা প্রতীক ব্যবহার করেন। ১৭৬৭ সালে জন্ম নেওয়া জ্যাকসন পূর্বসূরিদের তুলনায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এর কারণ হলোÑ তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি শুধু ‘সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘দুর্নীতিবাজ আভিজাত্য’র বিরুদ্ধেও সে সময় ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন জ্যাকসন। তার দুই মেয়াদে দুুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তারা হলেন জন সি. ক্যালহাউন এবং মার্টিন ভ্যান বিউরেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন টেনেসি অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। তার আগে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট দাস প্রথা বিরোধী ছিলেন। তার শাসন আমলে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে কৃতদাসদের কেনা এবং তাদের পুনর্বাসনের কাজ হয়েছিল। ১৮৩৩ সালের এক ঘটনা, প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে বন্ধুদের সঙ্গে ভোজন করছিলেন, তখন কেউ তাকে ফিসফিস করে বলেছিল যে সিনেট ইংল্যান্ডের মন্ত্রী হিসেবে মার্টিন ভ্যান বুরেনের মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করেছে। জ্যাকসন তখন চিৎকার করে বলেন, আমি তাদের ধ্বংস করব! পরবর্তীতে ভ্যান বুরেন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট হন। আর সেই সঙ্গে তিনিও অবসরে চলে যান। ১৮৪৫ সালে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন মৃত্যুবরণ করেন।

 

আব্রাহাম লিংকন [১৬তম প্রেসিডেন্ট]

প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় নির্বাচন কেন্দ্রের কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা লিংকন এক সময় নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। অত্যন্ত গরিব পরিবারে ১৮০৯ সালে জম্মগ্রহণ করেন লিংকন। পরবর্তীকালে স্বীয় প্রচেষ্টায় বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অধিপতি হতে পেরেছিলেন তিনি। শিক্ষা-দীক্ষাহীন লিংকন একটি গুদামের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটে লিংকনের। একটি প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। এরপর নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। এ ছাড়াও  প্রথম জীবনে এই প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভয়ঙ্কর মুষ্টিযোদ্ধা। প্রায় ৩০০-এর মতো যুদ্ধে লড়ে হেরেছিলেন মাত্র একটিতে। মজার ব্যাপার হলো মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা প্রেসিডেন্টের খেতাবটিও কিন্তু তাঁর। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার লিঙ্কনকে শুধু কীর্তিতে নয় শারীরিক উচ্চতায়ও আজ পর্যন্ত হারাতে পারেননি কোনো প্রেসিডেন্ট! আমেরিকা থেকে দাস প্রথা নিষিদ্ধ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিনি। ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি লিংকন চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটল। এই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, আমি আব্রাহাম লিংকন আদেশ দিচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে, উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোতে ক্রীতদাসরূপে যারা বন্দী রয়েছে তারা এখন থেকে স্বাধীন, মুক্ত। দাস প্রথা বিলুপ্ত হলো। যুদ্ধজয়ী লিংকন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। সময়টা ছিল ১৮৬৫ সাল। ঠিক তখন আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার কারণে তার জীবনকে ঘিরে রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

 

গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড [২২, ২৪তম প্রেসিডেন্ট]

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর ক্লিভল্যান্ড প্রথম নির্বাচিত ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট। গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে গিয়েছিলেন, চার বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসেন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২তম এবং ২৪তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন দুইবার তবে পরপর দুই নির্বাচনে নয়। মজার ব্যাপার হলো আমেরিকার ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি! ১৮৩৭ সালে জন্ম নেওয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন বোরবন ডেমোক্র্যাটের প্রধান নেতা। ৪৪ বছর বয়সে তিনি এমন রাজনৈতিক খ্যাতিতে আবির্ভূত হন, যা তাকে তিন বছরে হোয়াইট হাউসে নিয়ে যায়। ১৮৮৫ সালের আমেরিকান গৃহযুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ক্লিভল্যান্ড। ১৮৩৭ সালে জন্ম নেওয়া ক্লিভল্যান্ডই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং চার বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসেন। প্রথম জীবনে ছিলেন নিউইয়র্কের ছোট্ট এক কাউন্টির শেরিফ। উচ্চ শুল্ক ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান করা তার শাসন আমলে তিনি ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী ও কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি পরবর্তীকালে আমেরিকান আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। এ ছাড়া কর্মজীবনে তিনি দুইবার অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জল্লাদের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। হোয়াইট হাউস ত্যাগের পর ক্লিভল্যান্ড নিউ জার্সির প্রিন্সটনে বসবাস করেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি মারা যান।

 

জন এফ কেনেডি [৩৫তম প্রেসিডেন্ট]

আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র  আইরিশ প্রেসিডেন্ট ও আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। নানা গুঞ্জন থাকা সত্ত্বেও কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট

.মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। যিনি জেএফকে নামেই বেশি পরিচিত। ১৯১৭ সালে ম্যাসাচুসেটসের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন। আমেরিকার বিখ্যাত কেনেডি পরিবারের সন্তান তিনি। ছেলেবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল লেখক হওয়ার। সদা লাজুক কেনিডির রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা ছিল না। তারপরও তিনি আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত প্রেসিডেন্ট। মাত্র ৪৩ বছরে নির্বাচিত কেনিডি আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার সুদর্শন, রুচিশীল, ভদ্র, উচ্চশিক্ষিত ইমেজের পাশাপাশি আরেকটি ইমেজ হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। কেনেডি অনেকের কাছে প্লে বয় প্রেসিডেন্ট হিসেবেও পরিচিত। জগৎ বিখ্যাত সুন্দরী মেরিলিন মুনরো ছাড়াও জাইনি ম্যানসফিল্ড, ওডেরি হেপবার্ন, এঞ্জি ডিক্সনসহ অনেক সেলিব্রেটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। কেনেডি প্রথম ও একমাত্র ক্যাথলিক এবং প্রথম আইরিশ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামরিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে সাংবাদিকতা করেন। তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জেতা একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে ১৯৬২ সালের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট মোকাবিলা করেন।  ১৯৬৩ সালে কেনেডি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

 

জেরাল্ড আর ফোর্ড [৩৮তম প্রেসিডেন্ট]

আজ অবধি জেরাল্ড আর ফোর্ডই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো প্রকার নির্বাচনে না জিতেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে

আমেরিকার ৩৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘটনাটি সত্যিই অভূতপূর্ব। ইতিহাসে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি। ভাগ্য যেন জেরাল্ড ফোর্ডকে টেনে এনেছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। আর তাতে হোয়াইট হাউসের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেরাল্ড আর ফোর্ড। আমেরিকার ইতিহাসে তিনি একজন ভাগ্যবান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। প্রথমবার কোনো প্রকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়াই ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত হন। সে সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো ইগ্নেউ পদত্যাগ করেছিলেন। নতুন পদে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বছর না পেরোতেই আবার ভাগ্য খুলে যায় জেরাল্ড ফোর্ডের। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগের পর তিনিই গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব। মূলত আমেরিকার ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী নির্বাচন ছাড়া প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত হন জেরাল্ড ফোর্ড। জেরাল্ড আর ফোর্ড ১৯৭৪ সালে ৩৮তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় ঘোষণা করেছিলেন, আমি অসাধারণ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেছি। মজার বিষয় হলোÑ আজ অবধি তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো নির্বাচনে না জিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ঠাঁই পেয়েছিলেন। যদিও সে সময় তার জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতি আয়ত্তকরণ, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, দীর্ঘস্থায়ী শক্তির ঘাটতি সমাধান এবং বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করা। জেরাল্ড ফোর্ড তখন আমেরিকার সমাজ ও অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে সরকারি হস্তক্ষেপ ও ব্যয়ের ঝুঁকি রোধে কাজ করেছিলেন।

 

রোনাল্ড রিগ্যান [৪০তম প্রেসিডেন্ট]

রিগ্যান ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির অঙ্গনে। ৪০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখেন হোয়াইট হাউসে

রোনাল্ড উইলসন রিগ্যান, মূলত তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় একজন অভিনেতা। একসময় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তারপর ৪০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখেন হোয়াইট হাউসে। একজন সফল রাজনীতিক এবং অভিনেতা কেমন হতে পারে তার আদর্শ রোনাল্ড রিগ্যান। ১৯১১ সালে এই প্রতিভাবান ব্যক্তি জম্মগ্রহণ করেন। তার সিনেমা জগৎ হলিউডে অভিষেক ১৯৩৭ সালে। দেখতে দেখতে ৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনীত বিখ্যাত সিনেমাগুলোর মধ্যে অল-আমেরিকান, কিংস র, বেডটাইম ফর বঞ্জো উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন। মার্কিন রাজনীতিতে তার উপস্থিতি রাজনীতির পটপরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৮০ সালে জিমি কার্টারকে হারিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ব দেখে রিগ্যানের আগ্রাসী রূপ। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত শাসনামলে প্রথম আগ্রাসনের শিকার লেবানন। ১৯৮৩ সালে গ্রানাডা এবং ১৯৮৬ সালে বার্লিনের ডিস্কোবারে বোমা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে লিবিয়ায় হামলা চালান তিনি। জাতিসংঘ এই হামলায় তীব্র নিন্দা জানায়। তার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন জর্জ এইচডব্লিউ বুশ। ১৯৮১-এর ২০ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি অবসরে যান। ১৯৯৪ সালে তিনি আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হন। ২০০৪ সালে প্রতিভাবান এই আমেরিকানের শেষ প্রয়াণ ঘটে।

 

বিল ক্লিনটন [৪২তম প্রেসিডেন্ট]

২০০১ সালে অবসর নেন ক্লিনটন। এরপর নিজের ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন মানব কল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি

উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন। যদিও সবাই তাকে বিল ক্লিনটন নামেই চেনেন। ১৯৪৬ সালে আমেরিকার আরকানসাসে জন্মগ্রহণ করেন ক্লিনটন। পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পরবর্তীতে হন প্রেসিডেন্ট। রাজনীতির হাতেখড়িটা অনেক আগে হলেও ১৯৭৭-৭৯ মেয়াদে আরকানসাসের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ১৯৭৯-৮১ ও ১৯৮৩-৯২ মেয়াদে ছিলেন আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর। এরপর ১৯৯৩-২০০১ পর্যন্ত দুই মেয়াদে তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ১৯৯২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার জয় হবে এমন আশা কেউই করেননি। তবে এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী রস পেরুট অংশ নিলে ক্লিনটনের ভাগ্য খুলে যায় এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও ক্লিনটনের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তার মধ্যস্থতায় ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘অসলো শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, যা ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে। ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর নেন ক্লিনটন। এরপর নিজের প্রতিষ্ঠিত ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন মানবকল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত নারী কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ঘটে মার্কিন এই প্রেসিডেন্টকে নিয়েই। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ভয়াবহ বিপাকে পড়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে মার্কিন জনগণ ছিল ক্লিনটনের প্রতি দারুণ সহানুভূতিশীল।

 

জর্জ ডব্লিউ বুশ [৪৩তম প্রেসিডেন্ট]

আমেরিকানদের কাছে তো বটেই, গোটা বিশ্বের কাছেও জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র) এবং আগ্রাসী  ও যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশ সমালোচিত হন। এতে জনগণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং প্রতিবাদে সোচ্চার হন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। আমেরিকানদের কাছে তিনি বুশ জুনিয়র নামে সর্বাধিক পরিচিত। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ৪৬তম প্রশাসক বা গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৩০ কোটি ডলার কর মওকুফ করেন এবং ‘কোনো শিশু আইনের বাইরে থাকবে না’ শীর্ষক আইন প্রণয়ন করে বিশেষ আলোচিত হন। এ ছাড়া আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ হিসেবে তিনি ব্যাপক সমালোচিত। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পর তিনি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে উৎখাত করার জন্য সে দেশে আগ্রাসন চালান। মূল উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদা ধ্বংস করে ওসামা বিন লাদেনকে আটক করা। ২০০৩ সালের মার্চে বুশ ইরাক দখলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অজুহাত দেখিয়ে ইরাক দখল করলেও সেখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তার দেওয়া ঘোষণা মিথ্যা প্রমাণিত হয় ও নিন্দার ঝড় ওঠে।

 

বারাক ওবামা [৪৪তম প্রেসিডেন্ট]

মার্কিন সফল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি আমেরিকার ৪৪তম এবং প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। তার সফলতার জন্য টাইম ম্যাগাজিন পর পর দুইবার তাকে পারসন অব দ্য ইয়ার মনোনীত করে

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পুরো নাম বারাক হোসেন ওবামা জুনিয়র। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে তার জন্ম। আর্থিক অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও নানা-নানী ওবামাকে হাওয়াইয়ের ওই সময়ের সেরা স্কুলে ভর্তি করেন। স্কুলে থাকার সময় ওবামা বর্ণবাদের শিকার হন। রাজনীতিতে তার সফলতার গল্পটা দারুণ। ১৯৯৬ সালে তিনি ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হন। এ সময় নৈতিক আইন প্রণয়ন, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশু শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে তিনি ডেমোক্র্যাটস এবং রিপাবলিকান উভয়ের সঙ্গে কাজ করেন। ২০০৪ সালে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বস্টন শহরে অনুষ্ঠিত ডেমোক্র্যাট দলের জাতীয় সম্মেলনে বারাক ওবামা মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ওবামা জাতীয় পরিসরে মোটামুটি অচেনাই ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হন। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ২০১২ সালে পুনঃনির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সামান্য কৃতিত্বের জন্য বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০১১ এবং ২০১২ সালে ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ মনোনীত করে।

সর্বশেষ খবর