বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলা নববর্ষের যত ইতিহাস

তানভীর আহমেদ

বাংলা নববর্ষের যত ইতিহাস

ছবি : জয়ীতা রায়

খাজনা পরিশোধের গরমিলে পড়ে যেত বাংলার কৃষক। তাই প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কারের নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়। বাঙালির সর্বজনীন লোকোৎসব পয়লা বৈশাখ। একসময় মেলা, হালখাতা আর পুণ্যাহ উৎসব ছিল পয়লা বৈশাখের প্রাণ। বৈশাখী মেলায় থাকত গ্রামের কামার-কুমার আর তাঁতিদের হস্তশিল্পের আয়োজন। থাকত হাতে তৈরি মাটির খেলনা, মন্ডা-মিঠাই, চরকি, বেলুন, ভেঁপু, বাঁশি আর ভাজাপোড়া খাবার-দাবার। মেলার প্রধান আকর্ষণ ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই প্রতিযোগিতা ছিল জনপ্রিয়।  এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নৌকাবাইচ, বহুরূপীর সাজ, হাডুডু খেলার আয়োজনও থাকত। আশির দশকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন উচ্ছ্বাসে বৈশাখী উৎসব জমে ওঠে।

 

বাংলা নববর্ষের শুরু যেভাবে

আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রচলন ঘটে নববর্ষ উদযাপনের। তখন নতুন বছর শুরু হতো বসন্তকালের প্রথম চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। বসন্তকালকে তারা পুনর্জীবন, নতুন ফসল এবং ফুল ফোটার প্রতীক হিসেবে গণ্য করত। ১১ দিন ধরে চলত নববর্ষ উৎসব। রোমানরা তাদের বর্ষ গণনা শুরু করত মার্চ মাসের শেষ থেকে। তবে রোমান সম্রাটের শাসনামল পরিবর্তিত হলে এই রীতিও বদলে যেত। রোমান সিনেটররা খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালে ঘোষণা করে জানুয়ারির এক তারিখ হবে বছরের প্রথম দিন। কিন্তু তারপরও খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সাল পর্যন্ত সিদ্ধান্তের বারবার পরিবর্তন ঘটে। তারপর সম্রাট জুলিয়াস সিজার এক তারিখকেই আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে ইংরেজি বছরকে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ও বলা হয়। পরে ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি ঘোষণা করেন। তারপর থেকে তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি হিসেবে পরিচিত। এই সৌর ক্যালেন্ডারই বর্তমানের ইংরেজি বর্ষপঞ্জি। এবার আসা যাক, বাংলা নববর্ষ প্রচলনের ইতিহাসে। অংকের হিসাবে ইংরেজি ৫৯৩ সালে বাংলা সালের যাত্রা শুরু। এদিকে সম্রাট আকবর ক্ষমতায় আসেন ইংরেজি ১৫৫৬ সালে। অর্থাৎ বাংলা ৯৬৩ সনে তার সিংহাসন লাভ হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও ইতিহাস বলে, মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলে ফসলের জন্য ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজন পড়ে। তখন প্রচলিত হিজরি সনকে ‘ফসলি’ সন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু রাজ্যের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের ধর্মীয় ও অন্যান্য কাজে হিজরি সন ব্যবহারে আপত্তি জানান। সম্রাট আকবর বিষয়টি বিবেচনায় এনে হিজরি সন থেকে কিছু বছর বাদ দিয়ে বাংলা সন হিসেবে নতুন সৌরপঞ্জির প্রবর্তন করেন। তাই বলা যায় হিজরি সনের সিঁড়ি বেয়েই বাংলা সনের জন্মলাভ। পরবর্তীতে এই পঞ্জিকার হিসাবে তখনকার বার্ষিক কর, ভূমিকর, কৃষিকর, জলকর ইত্যাদি আদায় শুরু হয়। তথ্য অস্পষ্টতার জন্য অনেকে মনে করেন, সম্রাট আকবরের হাতেই বাংলা সনের গণনা শুরু। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো সম্রাটের হাতে হিজরি সনকে রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা সনের প্রবর্তন ঘটে। দিনে দিনে এই বাংলা বছর গণনায়ও এসেছে নানা পরিবর্তন। শুরুতে বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গাব্দের দিন ও তারিখ নির্ধারণে জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। এসব জটিলতা নিরসনে প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বঙ্গাব্দের বেশ কিছু সংস্কার করেন। যেমন গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দিনের সংখ্যা প্রতি মাসে ৩১ করা হয় এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৩০ দিন গণনার বিধান করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্কার কাজের স্বীকৃতি প্রদান করেন।

 

বাংলা পঞ্জিকার শুরু

সন শব্দটি আরবি থেকে আগত। অর্থ- বর্ষ, বর্ষপঞ্জি-বছরের দিনক্ষণের বিবরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার ভেদে রয়েছে নিজস্ব এমন পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। তেমনি বাংলা সনের হিসাব রাখতেও আছে নিজস্ব নিয়ম-নীতির পঞ্জিকা।

সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) নির্দেশে এবং বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পন্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি। তখন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের পরিবর্তে ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। তখনকার প্রচলিত হিজরি সনকে ‘ফসলি সন’ হিসেবে চালু করার মাধ্যমে বর্তমান বাংলা সন বঙ্গাব্দের জন্ম হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অব্দের উদ্ভব হয়। বাংলায় বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন অব্দের প্রচলন লক্ষ্য করেছি। যেমন- মল্লাব্দ, শকান্দ, লক্ষণাব্দ, পালাব্দ, নশরত, শাহী সন, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি লক্ষণীয় বিষয়। এসব অব্দ প্রচলনের পেছনে রাজ-রাজড়ার নাম জড়িত রয়েছে। কিন্তু বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রচলনের পেছনে যারই অবদান থাকুক না কেন, এ নামের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে বাঙালি জাতির নাম। সুতরাং বাংলা সন হচ্ছে বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ। নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে এখানে। এটি শুধু বাংলা বর্ষকেই নির্দেশ করে। এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাশিফল প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয়, রঘুনন্দন প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেন। এরপর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরও প্রসারিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্জিকা সংস্কার করে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার হয় এবং এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা  বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ   হিসেবে স্বীকৃত হয়।

 

আশির দশকে উৎসব জমে ওঠে

গ্রামবাংলার সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখ। সময়ের পালাবদলে নগরজীবনে পয়লা বৈশাখ উৎসব আয়োজনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আশির দশকের আন্দোলন, মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু- তারপরই নতুন আঙ্গিকে, নতুন উচ্ছ্বাসে বৈশাখী উৎসব জমে ওঠে। গ্রামবাংলার জীবনের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। শহুরে জীবনে পয়লা বৈশাখের আনন্দ আয়োজনে বহু সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। বাংলার ইতিহাস নতুন করে লেখা মুক্তিযুদ্ধের পর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলনে মানুষ দলে দলে যোগ দিতে শুরু করে। বাংলার মহান নেতা এ কে ফজলুল হক বাংলার মানুষকে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি সংগ্রামের পথ দেখিয়েছিলেন সে পথেই পয়লা বৈশাখে বাংলার মানুষ একসঙ্গে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। ছায়ানট বহু আগে পয়লা বৈশাখ পালনে উৎসব আয়োজন করলেও এখন আমরা যে ধরনের উৎসব দেখি তার জনপ্রিয়তা আশির দশকে। পান্তা-ইলিশের চলটাও একেবারে নতুন। এসবের সঙ্গে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যমাখা পয়লা বৈশাখের কোনো সম্পর্কই নেই। পয়লা বৈশাখ বলতেই একসময় ছিল বটতলায় বৈশাখী মেলা। নাগরদোলা, মিষ্টি-মন্ডা, গ্রামীণ নারীর চুড়ি-আলতা, ঢাক-ঢোলে লোকসংগীত। ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু। ছায়ানটের বটতলায় বর্ষবরণের সংগীত আয়োজনের ইতিহাস পুরনো হলেও আশির দশকের পর পয়লা বৈশাখের চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। তাই বলে পয়লা বৈশাখের আবেদন বদলে গেছে- এমনটা ভাবা ভুল হবে। গ্রামবাংলার চিরায়ত গ্রামীণ উৎসবের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনায় পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষকে সব সময়ই আলোড়িত করে একই আবেদনে, গুরুত্বে ও আবেগে। আনন্দঘন পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে সবাই মুখিয়ে থাকে এদিনটির জন্য। অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন উৎসব বলে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ছুটে আসে রমনা বটমূলে, মঙ্গল শোভাযাত্রায়। নতুন সূর্যস্নানে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় শহরের মানুষ।

ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরে, রবীন্দ্র-নজরুলের গানে, সুরে মেতে ওঠে সবাই। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। এখনো বৈশাখী মেলায় মানুষের ভিড় জমে। বাচ্চারা কেনে খেলনা। মিষ্টি-মন্ডায় মুখরোচে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। পিঠা, পায়েস ও নানা রকম লোকজ খাবার দিয়ে আপ্যায়নের রীতি এখনো মেনে চলে অনেকে। মহল্লায় মহল্লায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য মিছিল, বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়, সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। তবে এ বছর করোনা মহামারীর কারণে  উৎসব আয়োজনে রয়েছে বিধিনিষেধ।

সর্বশেষ খবর