ইউক্রেনের আকাশে উড়বে ফিনিক্স ঘোস্ট
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের দখল নিতে চলেছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভ থেকে সরে গেলেও ইউক্রেনের বড় বড় শহরে তীব্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। রুশ বাহিনীর এ হামলার মোকাবিলা করতে মিত্রদেশগুলোর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সহায়তা চেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। খেরসন ও মারিওপোল অঞ্চলে রুশ বাহিনীর তান্ডবের পর ইউক্রেন অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। যে শহরকে টার্গেট করেছে, সেটিকে পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে রুশ সেনাবাহিনী। পুরো শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। কিছু অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনাদের ঘিরে রেখেছে রুশ সেনারা। রাশিয়ার সেনাদের এমন আধিপত্য রুখতে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে নতুন করে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন।
সবশেষ ঘোষণা করা সহায়তার আওতায় ইউক্রেনকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে কেবল সামরিক সাহায্য দেওয়ার ঘোষণাই দিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে এম-৭৭৭ হাউৎজার কামান, হামভি সামরিক যান, কামানের গোলা থাকছে। এই চালানে নতুন এক ধরনের সামরিক অস্ত্র থাকছে, যা নতুন কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। অজ্ঞাতনামা এই আকাশচারী অস্ত্র বা ড্রোনটিকে ডাকা হচ্ছে ‘ফিনিক্স ঘোস্ট’। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিনিক্স ঘোস্ট এক ধরনের মনুষ্যবিহীন বোমারু বিমান (ড্রোন)। বিশেষ এই ড্রোনটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান অ্যায়েভেক্স অ্যারোস্পেস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবির দাবি, পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে হামলার জন্য ড্রোনটি বিশেষভাবে কার্যকর। কিরবি আরও বলেন, ‘পাহাড়ের খাঁজে অবস্থান করা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে ফিনিক্স ঘোস্টের।’ তবে ড্রোনটির সক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাননি কিরবি। তিনি আরও জানিয়েছেন, এখনো ইউক্রেনের হাতে ড্রোনটি পৌঁছায়নি। শিগগিরই ড্রোনটি ইউক্রেন পেতে যাচ্ছে বলে তার কথায় ইঙ্গিত রয়েছে। মাত্র একবার ব্যবহার উপযোগী এ অস্ত্রটিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ড্রোন হিসেবে উল্লেখ করেছে আমেরিকা।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার আগেই এই ড্রোন তৈরি হয়েছিল। তবে এ পর্যন্ত কোথাও ব্যবহার করা হয়নি অস্ত্রটি। রাশিয়ার ওপর পরীক্ষা চালাতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১২১টির বেশি ফিনিক্স ঘোস্ট পাঠাবে বলে জানিয়েছে। দেখতে ছোটখাটো এই অস্ত্রের ওপর পেন্টাগনের ভীষণ ভরসা।
ক্রিমিয়ার সঙ্গে স্থল যোগাযোগ তৈরিতে মরিয়া রাশিয়া
কৃষ্ণ সাগরে শক্তিশালী সমুদ্রবন্দর রয়েছে ইউক্রেনের। রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে আজভ সমুদ্রে। এ অঞ্চলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে এ সমুদ্র দুটিতে নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দর শহর ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনকে চাপে ফেলতে সে সেনা অভিযানের পর থেকেই হুমকির মুখে ছিল ইউক্রেন। তারই পরিণতিতে দুই মাস আগে রুশ সেনা অভিযান। এর পেছনে বড় কারণ রাশিয়া চায় ক্রিমিয়ার সঙ্গে স্থল যোগাযোগ তৈরি করতে। রাশিয়ার সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল রুস্তাম মিনেকায়েভ বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস এলাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এ বক্তব্যটি রাশিয়ার গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এ লক্ষ্য অর্জিত হলে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ভূখন্ডের একটি সরাসরি স্থল যোগাযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়াও এটি মস্কোর সঙ্গে মলদোভায় রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্রান্সনিস্ত্রিয়া অঞ্চলের যোগাযোগ তৈরি করতেও সহায়তা করবে।
পুতিনের হাতে লাল মোমবাতি
পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের দিকে। তিনি একাই পারেন পুরো যুদ্ধের চিত্র বদলে দিতে। অবশ্য তিনি শুরু থেকেই অনড় রয়েছেন এ যুদ্ধে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে হঠাৎ পুতিনকে দেখা গেল লাল মোমবাতি হাতে। মধ্যরাতে খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ইস্টারের গণজমায়েতে যোগ দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। সাদা শার্টের সঙ্গে গাঢ় নীল রঙের স্যুট আর বেগুনি টাই ছিল পুতিনের পরনে। মস্কোর সেভিয়র ক্যাথেড্রালে লাল মোমবাতি হাতে ইস্টার উপলক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এই রুশ নেতা। এ সময় দ্রুতই যেন ইউক্রেন সংঘাত থামে সেই প্রার্থনা করেন গির্জার প্রধান যাজক। বিশ্বের নানা দেশ থেকে এর নিন্দা এলেও সেভিয়র ক্যাথেড্রাল সব সময় পুতিনের পাশেই আছে। তারা এই সেনা অভিযানের কোনো নিন্দা করেনি।
লড়ছে ইউক্রেন
ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সেনা অভিযানের দুই মাস পেরিয়ে গেছে। পূর্বাঞ্চলের শহরগুলো এরই মধ্যে চলে গেছে রাশিয়ার দখলে। কিছু অঞ্চলে চলছে প্রবল যুদ্ধ। রাশিয়ার বোমা হামলায় ভেঙে পড়ছে ইউক্রেনের দালানকোঠা। ঘরবাড়ি ছেড়েছে মানুষ। ইউক্রেনের সেনারা কিছু অঞ্চলে মুখোমুখি সংঘর্ষে ভালোই জবাব দিচ্ছে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি বিবেচনায় রুশ সেনারা যেভাবে একের পর এক শহরে প্রবেশ করছে তাতে ইউক্রেন উদ্বিগ্ন হতেই পারে। দুই পক্ষের সেনা মারা যাচ্ছে এই প্রবল যুদ্ধে। রুশ বাহিনীর তীব্র হামলায় ধ্বংসের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। এসব হামলার জবাব দিচ্ছে ইউক্রেনের সেনারা। গতকাল শুক্রবারও খেরসন শহরে রাশিয়ার সেনা কমান্ডের একটি পোস্ট ধ্বংস করার দাবি করেছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার সেনা পোস্টে হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনায় দুই রুশ জেনারেল নিহত হয়েছেন। বাকি একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ওলেকসি আরেস্তোভিচ জানিয়েছেন, রাশিয়ার ওই নির্দেশনা কেন্দ্রে ইউক্রেনীয় হামলার সময় ৫০ জন জ্যেষ্ঠ রুশ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি তিনি। এর আগেও কয়েকজন রুশ জেনারেলকে হত্যা করার দাবি করেছিল ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া ওডেসা শহরে রাশিয়ার দুটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। ওডেসা সিটি কাউন্সিলের প্রেস দফতর এক টেলিগ্রাম পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘২৩ এপ্রিল রাত ১০টায় ওডেসা এলাকার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল ইউনিটের সেনারা রাশিয়ার দুটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে। কৃষ্ণ সাগরে থাকা রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র দুটি ছোড়া হয়েছিল। ক্ষেপণাস্ত্র দুটির লক্ষ্যবস্তু ছিল পিভদেনি বন্দর।’ ইউক্রেনের দাবি, শনিবার রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ওডেসায় আটজন মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরও ১৮ জন। এ ধরনের দাবির বিপরীতে রুশ কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করেনি। এ পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষভাবে এসব দাবি ও পাল্টা দাবি যাচাই করা সম্ভব হয় না। তবে যুদ্ধের চিত্র বলে দিচ্ছে দিন যতই গড়াচ্ছে, ইউক্রেনের ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়ছে।