বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

আধুনিক যত মারণাস্ত্র

আবদুল কাদের

আধুনিক যত মারণাস্ত্র

দিন যত গড়াচ্ছে আধুনিকায়ন হচ্ছে মারণাস্ত্রের। বিশ্ব দেখছে ভয়ানক অস্ত্রের ক্ষমতা। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দেখা মিলেছে আধুনিক সব মারণাস্ত্রের। ক্ষমতাধর দেশগুলোর হাতে রয়েছে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ ও বিধ্বংসী ড্রোন প্রযুক্তি। এসব মারণাস্ত্র ব্যবহার করে চলছে নিখুঁত হামলা। আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে আজকের রকমারি-

♦ বিধ্বংসী কালিবার মিসাইল অন্তত সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম।
♦ ভ্যাকুয়াম বোমার বিস্ফোরণ প্রচলিত বোমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী শকওয়েভ তৈরি করতে সক্ষম।
♦ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় লক্ষ্যবস্তুর ওপরে অবস্থান করতে পারে এবং ক্ষিপ্রগতিতে আঘাত হানতে পারে কামিকাজি ড্রোন।

 

রাশিয়ার ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র এবং ইউক্রেনের প্রতিরোধ

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের সূচনা ক্রাইমিয়া দখলের মাধ্যমে। আর দখলদারিত্বের শুরুটা ক্রাইমিয়া দিয়ে হলেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করে গেল বছর ইউক্রেন হামলার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে রুশ আগ্রাসনের দেড় বছর পার হয়েছে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী, রাশিয়ান ফেডারেশনের সশস্ত্র বাহিনী, দোনেস্ক পিপলস রিপাবলিক পিপলস মিলিশিয়া, লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক পিপলস মিলিশিয়া এবং আরও অনেকগুলো জাতীয় রক্ষী এবং স্বেচ্ছাসেবক দল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র। মনে রাখা ভালো, যে কোনো সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধে নতুন নতুন অস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে রুশ বাহিনী নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে। যার মধ্যে পরীক্ষামূলক যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যাও কম নয়। তবে এসবের বাইরেও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি সমরাস্ত্র বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছে। এসব আধুনিক অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- কেএ-৫২ই এলিগেটর ও এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার, সুখোই-৫৭ই ও সুখোই-৩৫ যুদ্ধবিমান, ইস্কান্দার-ই কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা এবং টি-৯০ ট্যাংক।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া অত্যাধুনিক, নির্ভুল লক্ষ্য ও বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ফলে বিশ্বে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের কদর বেড়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্রে পিছিয়ে নেই ইউক্রেনও। এসব অস্ত্র দিয়ে রণক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি শক্ত অবস্থানে রয়েছে তারা...

রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রোসোবোরোনেক্সপোর্টের প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্দার মিখেয়েভ ঘোষণা করেছেন, ‘চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও নতুন রপ্তানি চুক্তিতে প্রস্তুত রাশিয়া। যুদ্ধে রাশিয়ার আধুনিক অস্ত্রের ভাণ্ডার নিয়ে মিত্র দেশগুলোর আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলেছে। অত্যাধুনিক, নির্ভুল ও বিধ্বংসী প্রভাবসহ ব্যাপকভাবে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি ইস্কান্দার-এম। যা ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম। এর সেন্সর ও নেটওয়ার্ক সিস্টেম এমনভাবে তৈরি যা চারপাশের লক্ষ্যবস্তুতে দ্রুত আক্রমণ চালাতে পারে। পাশাপাশি রাশিয়া কেএ-৫২ই এলিগেটর ও এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টারের ব্যবহার করেছে। এগুলো উন্নতমানের গ্রাউন্ড-অ্যাটাক হেলিকপ্টার। যাতে রয়েছে আধুনিক গানশিপ সিস্টেম। যা ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সুখোই-৫৭ই ও সুখোই-৩৫ যুদ্ধবিমানও ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। স্ট্যান্ড-অব আক্রমণে এদের সক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে রণক্ষেত্রে। তালিকার পরের যুদ্ধাস্ত্র টি-৯০এম এবং টি-৯০ ট্যাংক। যদিও ইউক্রেন ব্যাপকভাবে ট্যাংকবিরোধী অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কারণে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ট্যাংক হারিয়েছে। তবুও রাশিয়ার এ ট্যাংকের ব্যবহার তাকে অনেক এগিয়ে রেখেছে। রোসোবোরোনেক্সপোর্টের প্রধান নির্বাহী আরও জানিয়েছেন, এর বাইরেও টিওএস-১এ হেভি ফেমথ্রোয়ার সিস্টেম, সাপোর্ট কমব্যাট ভেহিকেল (বিএমপিটি), অরলান-১০ই এবং ওরিয়ন-ই যুদ্ধাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে সফল। শুধু এগুলোই নয়, ক্লাব-এস এবং ক্লাব-এন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, প্যান্টসির-এস ১ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম, ভাইকিং এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম, টর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ইগলা-এস এবং ভারবা ম্যানপ্যাডস এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যুদ্ধব্যবস্থা, যার মধ্যে অন্যতম অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম ড্রোনও দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অন্যদিকে ইউক্রেনও রাশিয়ার ভয়ংকর সব অস্ত্রের বিপরীতে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ বাহিনীকে একের পর এক বাধার মুখে ফেলেছে তারা। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্র। রুশ বাহিনীর হামলার অস্ত্র দিয়ে কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। সমরবিদদের মতে, ‘এ অস্ত্রগুলো যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিয়েভ এই পশ্চিমা সহায়তা না পেলে রাশিয়া হয়তো এত দিনে যুদ্ধে জয় পেয়ে যেত।’ এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে কাঁধ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, বেরাকতার টিবি-২ ড্রোন, এইচএআরএম ক্ষেপণাস্ত্র, এম৭৭৭ হোইৎজার, হাইমার্স ও অন্যান্য রকেট উৎক্ষেপণব্যবস্থা, এস-৩০০ ও অন্যান্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ব্রাডলি সাঁজোয়া যান। আরও আছে অত্যাধুনিক ট্যাংক টি-৭২, আব্রামস, চ্যালেঞ্জার-২ ও লেপার্ড-২ স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যান, প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান, জিএলএসডিবি।

 

যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে কামিকাজি ড্রোন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের সামরিক ড্রোন ব্যবহার করছে। তন্মধ্যে অন্যতম কামিকাজি ড্রোন। কামিকাজি অর্থ আত্মঘাতী। সাধারণত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর ড্রোনগুলো আবার ঘাঁটিতেই ফিরে আসে যদি প্রতিপক্ষ সেগুলোকে ধ্বংস না করে। কিন্তু এ ড্রোনগুলো আক্রমণের পরপরই ধ্বংস হয়। এ ড্রোনগুলো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো। তারা শত শত কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু কামিকাজি সস্তা। আর সে কারণে চলমান যুদ্ধে এর ব্যবহারও বেড়েছে কয়েকগুণ। সমরবিদদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানি কামিকাজি আক্রমণের ফলে মিত্রশক্তির ৭ হাজার নৌ-সেনা নিহত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও ইরানের ‘শাহেদ-১৩৬’ কামিকাজি ড্রোন ব্যাপক ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে।

 

যুদ্ধক্ষেত্রে তুরস্কের টিবি- ড্রোন

বেরাকতার টিবি-২ হলো তুরস্কের নির্মিত সবচেয়ে বেশি আক্রমণকারী ড্রোন। এ ড্রোন আকাশে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে এবং শত্রুপক্ষের ওপর বৃষ্টির মতো লেজার-গাইডেড রকেট ছুড়তে পারে। সমরবিদদের মতে, এটি এমন এক যুদ্ধাস্ত্র যা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং হামলায় অংশ নিতে পারে। শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, সাঁজোয়া যান এবং অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি ঘণ্টায় ১২৯ কিলোমিটার থেকে ২২২ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। সর্বোচ্চ ৭০০ কেজি ওজন নিতে সক্ষম এ ড্রোন। মোট জ্বালানি ধরে ৩০০ লিটার। এতে চারটি লেজার গাইডেড স্মার্ট রকেট সংযুক্ত, যা লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত করতে সক্ষম। ২০১৪ সাল থেকে তুরস্ক বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন ও বিক্রি করলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তা বিশেষ নজর কেড়েছে।

 

ল্যান্ডমাইন ধ্বংসে কার্যকর ক্লাস্টার বোমা

ক্লাস্টার বোমা ছোট একটি সাবমেরিনকে উড়িয়ে দিতে পারে। এটি বৈদ্যুতিক পাওয়ার ট্রান্সমিশন, যুদ্ধবিমানের রানওয়েকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ বোমার সাহায্যে রাসায়নিক বা জৈবিক অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। ল্যান্ডমাইন ধ্বংস করতে এ বোমা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে যানবাহন ধ্বংসের পাশাপাশি মানুষ হত্যা করা যায়। আক্রমণের সময় অনেক ছোট ছোট বোমা একসঙ্গে ফেলা হয়, যা প্রতিপক্ষের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। এসব ক্লাস্টার বোমা যদি মাটিতে পড়ে না-ও ফাটে, তা হলেও তা বহুদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লাস্টার বোমা প্রথম আবিষ্কৃত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এগুলো এমন বোমা যা বিমান থেকে ফেলার পর মাঝ আকাশে ভেঙে বা খুলে যায় এবং সেখান থেকে শত শত ছোট বোমা বেরিয়ে মাটিতে পড়তে থাকে।

 

দূরপাল্লার অত্যাধুনিক ক্রুজ মিসাইল কালিবার

রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক ক্রুজ মিসাইল হলো কালিবার মিসাইল। ন্যাটোতে এটি সিজলার নামে পরিচিত। ২০১২ সালে প্রথম এ বোমার দেখা মেলে। প্রতিটি মিসাইলের ওজন ২৩০০ কেজি। এ ক্ষেপণাস্ত্রটি ৫০০ কেজি ওজনের (১০০০ পাউন্ড পর্যন্ত) বিস্ফোরক বা থার্মোনিউকিয়ার বোমা বহন করতে পারে। জল, স্থল এবং আকাশ পথ- তিনভাবেই এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করতে পারে। কেএইচ-১০১ ও কেএইচ-৫৫৫, এ মিসাইল দুটি ৩ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে সক্ষম। এর আগে, সিরিয়া যুদ্ধে মিসাইল দুটির ব্যবহার হয়েছিল। সাধারণত টিইউ-৯৫এমএস, টিইউ-১৬০ বোমারু বিমান ও সুখই এসইউ-৩৪ জঙ্গি বিমানের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা হয় এ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। গত বছর রাশিয়া দাবি করেছিল প্রায় ২০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য এবং ৮০০ বিদেশি ভাড়াটে সৈন্যকে এ ভয়ংকর মিসাইলের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।

 

ভয়ংকর সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কিনজাল মিসাইল

রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ভয়ংকর কিনজাল। রাশিয়ার দাবি, নিজেদের তৈরি সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র এ ‘কিনজাল’। তাদের দাবি, এটি দিয়ে ইউক্রেনের একটি অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি একেবারে আধুনিক, ছুটতে পারে শব্দের চেয়ে ১০ গুণ বেশি গতিতে। এটি ২ হাজার কিলোমিটার বা তার বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে। এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম। এ ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেডও বহন করতে পারে। ভূগর্ভস্থ অস্ত্র ভাণ্ডারও ধ্বংস করতে সক্ষম এ ক্ষেপণাস্ত্র। ৪৮০ কেজি ওজন পর্যন্ত পরমাণু বোমা বহন করতে পারে কিনজাল হাইপারসনিক। কিনজালের দৈর্ঘ্য ৮ মিটার, ব্যাস ১ মিটার এবং এর ওজন প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কেজি। সবচেয়ে বড় কথা হলো- অস্ত্রটি এর আগে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা শোনা যায়নি। সমরবিদদের ধারণা- রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো পরাশক্তি কয়েকটি দেশের কাছে এ অস্ত্র-প্রযুক্তি রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রাশিয়া।

 

রুশ হামলার হাতিয়ার ইস্কান্দার মিসাইল

সিরিয়া যুদ্ধে বিধ্বংসী ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইলের ব্যবহারে ইউরোপ, আমেরিকা এবং রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেরই টনক নড়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেও রাশিয়ার হামলায় এ মিসাইল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বলা যায়, স্বল্পপাল্লার এ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে রুশ হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইস্কান্দার মিসাইলের দাম জানালেও এর সঠিক ধরন নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। এ ক্ষেপণাস্ত্রটির কয়েকটি ধরন রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম কাস্টার মিউনিশন ওয়্যারহেড। যা কেবল জল ও স্থল থেকে নিক্ষেপ করা হয়। এটি একটি অত্যাধুনিক উচ্চ-বিস্ফোরক ফ্র্যাগমেন্টেশন ওয়্যারহেড। প্রতিটি ইস্কান্দারের দাম দেখানো হয়েছে ৩ মিলিয়ন ডলার। যদিও তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। ইউক্রেনে এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে ইস্কান্দারের ব্যালিস্টিক ভার্সন ৯এম৭২৩। আর এটির ক্রুজ ধরন আর-৫০০। এ দুটির দামও ভিন্ন ভিন্ন। কারণ ব্যালিস্টিকের চেয়ে ইস্কান্দার মিসাইলের ক্রুজ সংস্করণটি অত্যাধুনিক। ইস্কান্দার এম স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রটি ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকেও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ওজন ৪ হাজার ৬১৫ কেজি এবং প্রতিটি ওয়্যারহেডের ওজন ৭১০-৮০০ কেজি।

 

সামরিক স্থাপনা ধ্বংসে কার্যকরী রকেট

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে ব্যবহৃত সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রের মধ্যে একটি হলো বায়রাক্টার। এর বাইরেও বিএম-২১ গ্রেড, স্মার্স রকেট (টর্নেডো) এবং অর্গান (হ্যারিকেন) ইত্যাদি রকেটগুলো ব্যাপক ধ্বংসাত্মক। রকেটগুলো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা বা সৈন্যদের ঘাঁটি ধ্বংসের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ লঞ্চারগুলো বেসামরিক এলাকায় আঘাত হানলে এর ভয়াবহতাও ব্যাপক আকার ধারণ করে। আর হতাহতের সংখ্যা ধারণার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম (এমএলআরএস) নিযুক্ত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম বিএম-২১। ১৮টি লঞ্চারের ব্যাটালিয়নে ৭২০টি রকেট সরবরাহ করতে সক্ষম। তবে এ রকেটগুলো ব্যবহারে অত্যন্ত নির্ভুলতার প্রয়োজন হয়। তাই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে কয়েকটি রকেট একসঙ্গে ছোড়া হয়।

 

রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে পার্থক্য গড়ছে হাইমার্স মিসাইল

ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রগুলোর মধ্যে হাইমার্স মিসাইল অন্যতম। এটি অত্যাধুনিক হাইপারসনিক মিসাইল হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটি পাঁচ টন ট্রাকের ্রওপর ভিত্তি করে নির্মিত। সমরবিদদের মতে, হাইমার্স ক্ষেপণাস্ত্রে একাধিক লঞ্চ রকেট সিস্টেম রয়েছে। যার মাধ্যমে সব রকেট একসঙ্গে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। একটি এম-১৪২ হাইমার্স মিসাইল ৮০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম। মিসাইল সিস্টেমটি লম্বায় ৭ মিটার। প্রস্থে ২ দশমিক ৪ মিটার ও উচ্চতায় ৩.২ মিটার। দীর্ঘ পরিসরের পরিবর্তে নির্ভুলতাই এ মিসাইলের বিশেষত্ব। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইউক্রেন তার নতুন আর্টিলারি ব্যবহার করে দিনিপার নদীর বুকজুড়ে কমপক্ষে তিনটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যেগুলো দিয়ে রাশিয়া তার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে চলাফেরা করত।

 

শব্দের চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আবারও আলোচনায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। একেকটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতে পারে শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয়গুণ বেশি গতিতে। ঘণ্টায় এর গতি ৬ হাজার ১৭৪ কিলোমিটার বা ৩ হাজার ৮৩৬ মাইল। এককথায় এর গতি চূড়ান্ত পর্যায়ের। বায়ুমণ্ডলের উঁচু স্তরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় নিঃশব্দে ও অবিরত ছুটতে থাকে এবং এটা অত্যন্ত কৌশলী। ছোড়ার পরও এটির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যাওয়ার সময় এটি একটি অগভীর স্থানে উঁচু স্তর ও এলোমেলো বক্ররেখায় ছোটে। কারণ, শত্রুপক্ষ যেন এর অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে। এটা থেকে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় যে, এ মিসাইল কত দ্রুতগামী এবং কেন এর মোকাবিলা করা কঠিন।

 

যুদ্ধক্ষেত্রে নৃশংস অস্ত্র হলো ভ্যাকুয়াম বোমা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস বোমা হিসেবে আলোচিত ভ্যাকুয়াম বোমা। ২০২২ সালে প্রথম রাশিয়া ইউক্রেনে ভ্যাকুয়াম বোমা বা থার্মোবারিক অস্ত্র ব্যবহার করে ৭০ জন সৈন্যকে হত্যা করার অভিযোগ করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মার্কারোভা। প্রাণঘাতী এ বোমা একই আকারের অন্য যে কোনো সাধারণ বোমার চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী, যা বিস্ফোরণের এলাকায় যে কারও ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চ-তাপমাত্রার বিস্ফোরণ তৈরি করতে চারপাশের বাতাস থেকে অক্সিজেন শুষে নেয়। বিস্ফোরণ ঘটালে প্রচলিত বোমার তুলনায় শক্তিশালী শকওয়েভ তৈরি হয়। এ ধরনের অস্ত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এবং বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে।

 

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফসফরাস বোমা

২০২২ সালে প্রথম ফরফরাস বোমা ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছিল ইউক্রেন। মূলত শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করতে এবং সৈন্যদের গতিবিধি গোপন করার জন্য ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে এ বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়, তবে তা বেসামরিক এলাকায় ব্যবহার করাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বোমা দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে যা নেভানো কঠিন। সাদা ফসফরাস একটি মোমের মতো পদার্থ যা অক্সিজেনের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করে। এটি ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জ্বলে ও মানুষের মাংস বাজেভাবে পুড়ে ফেলে। এটি মানবদেহের কিডনি, লিভার এবং হৃৎপিণ্ডকে বিষাক্ত করে ফেলে। এটি অত্যন্ত আঠালো ও অপসারণ করা কঠিন এবং ব্যান্ডেজ সরানোর পরও জ্বালাপোড়া করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর