প্রাচীন গ্রিসের মহাজ্ঞানী
সক্রেটিস। একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। তিনি নিজে কিছু রচনা করে না গেলেও তাঁর জ্ঞানের মূলধন গ্রহণ করে পরবর্তী ২ হাজার বছর ধরে উপকৃত হয়েছে পশ্চিমা দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। ইউরোপের দেশ গ্রিসে ৪৬৯ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে মতান্তরে ৪৭০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে এই দার্শনিকের জন্ম। যদিও ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে তাঁর শৈশব সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য মেলেনি। তবে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য অবশ্যই মিলেছে। বাবা সফ্রোনিসকাস। যিনি ছিলেন একজন স্থপতি (রাজমিস্ত্রি, অন্যমতে ভাস্কর)। মা ফায়েনারেত ছিলেন একজন ধাত্রী। অ্যালোপেস নামক অঞ্চলে বেড়ে ওঠেন সক্রেটিস। তখনকার দিনে এথেন্সের নিয়ম ছিল, ১৮ বছর বয়স হলে যে কোনো তরুণকে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হতো। সে সময় তাদের বাধ্যতামূলক মিলিটারিতে যোগ দিতে হতো। অন্যদিকে মিলিটারি-বিষয়ক বিভিন্ন দিক নির্ধারণ এবং বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য যে অ্যাসেম্বলি ছিল তাতেও যোগ দিতে হতো। এসব কাজে কোনো আপত্তি ছিল না সক্রেটিসের। তখনকার এথেন্স সমাজে নারীর সৌন্দর্যের চেয়ে পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা হতো। সক্রেটিস গ্রিসে সত্য বাণী প্রচার করায় তদানীন্তন শাসনকর্তা ও এলিট সোসাইটি এটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে এক করুণ মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে হয় প্রাচীন গ্রিসের এই মহাজ্ঞানীকে।
মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের জীবনকাহিনি আমরা জানতে পারি তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য প্লেটোর রচনাবলি থেকে। প্লেটোর সব গ্রন্থেরই নায়ক হচ্ছেন সক্রেটিস। পথেঘাটে সবখানে তত্ত্বকথার আলোচনা করতেন সক্রেটিস। সক্রেটিস তাঁর নিজ দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাস্তাঘাট, হাটবাজার প্রভৃতি যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে বিনামূল্যে তিনি দর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, কোনো কিছুকেই তিনি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতেন না। জ্ঞানের অন্বেষণেই সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে। তাঁর মতে, জ্ঞান হচ্ছে আসলে জিজ্ঞাসা এবং অন্বেষা। তিনি বলতেন, আমরা সবাই নিশ্চিন্তে সব সময় বলি, আমরা সবকিছু জানি। আসলে আমরা কতটুকু জানি? সক্রেটিসকে সবাই সবচেয়ে জ্ঞানী বলতেন সে সময়। উল্টো তিনি পরিহাস করে বলেছিলেন, আমাকে কেন লোকে জ্ঞানী বলে, আমি কতটুকু জানি, এ প্রশ্নের রহস্য ভেদ করার জন্য আমি কত মানুষকে প্রশ্ন করেছি। নানা সমস্যা সম্পর্কে আমি তাদের প্রশ্ন করেছি। যাকে প্রশ্ন করেছি, সে-ই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। দিনের পরিভ্রমণ শেষে ক্লান্ত দেহে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এত সব জ্ঞানীর সঙ্গে আমার যদি কিছু পার্থক্য থাকে তা এই যে, আমি জানি যে, আমি কিছু জানি না; কিন্তু এরা জানে না যে, এরা কিছু জানে না। সরলতা এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে এথেন্সের তরুণদের কাছে প্রিয় করে তোলে।
আর এই জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়ায় সক্রেটিসের। তখনকার দিনের প্রচলিত ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে তরুণদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তৎকালীন এথেন্সের নীতিনির্ধারকরা। এথেন্স সরকার সক্রেটিসকে তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তখনকার দিনের আইন অনুসারে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগের যৌক্তিকতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সক্রেটিসকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়। অন্যথায় হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু সক্রেটিস ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত চিন্তাশীল, কোনো কিছুকেই তিনি স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেননি। সব কিছুর মহত্ত্ব, গুরুত্ব ও পবিত্রতা সম্বন্ধে তিনি প্রশ্ন করেছেন, সব কিছুকেই বিচার করতে চেয়েছেন। যে গণতন্ত্রের জন্য এথেন্সের সংগ্রাম, সেই গণতন্ত্রের নানা দিক সম্বন্ধেও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তার ফলে তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির অভিযোগ। সক্রেটিস তাঁর জবানবন্দিতে স্পষ্ট বলেছিলেন, তিনি তাঁর বিবেকের দ্বারা চালিত হতে চান এবং দেশের নীতি ও রীতির চেয়ে ঈশ্বরকে মানা শ্রেয় মনে করেন। সক্রেটিসের শিষ্যরা তাঁকে গোপনে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ন্যায়পরায়ণ সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা গোপনে পলায়ন- কোনোটাই করতে রাজি হননি। তাঁর জীবন ত্যাগের এ কাহিনি তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। সক্রেটিস তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, স্বেচ্ছায় কেউ কুকর্ম করে না। সক্রেটিসের বিবেচনায় এটা একেবারেই অসম্ভব যে, কেউ জেনেশুনে পাপ করবে।
৫০১ জন বিচারকের সামনে তাঁর বিচার হয়
৩৯৯ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে যখন সক্রেটিসের বিচার হয়, তখন তাঁর বয়স ৭০ বছর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রদ্রোহিতার। অভিযোগ তোলেন তখনকার দিনের রাজনীতিবিদ আনুতুস। বলা হয়, সক্রেটিস প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ধর্মের ক্ষতিসাধন করেছেন। তবে সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, দেবত্ব যৌক্তিকতার অন্য নাম। একে একে আরও অসংখ্য অভিযোগ জমেছিল।
৫০১ জন বিচারকের সামনে তাঁর বিচার হয়। তখনকার এথেন্সে উকিলের ব্যবস্থা ছিল না। আসামি এবং ফরিয়াদি উভয়েই বিচারকের সামনে তাদের বক্তব্য ব্যক্ত করতেন। বিপুলসংখ্যক বিচারকের মধ্যে সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মাত্র ৬০ জন বিচারকের ভোটাধিক্যে। বিচারের কাঠগড়ায় ২২১ জন তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। এর বিপরীতে ২৮০ জন সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এর পরও সক্রেটিস নিজের যুক্তিতে অনড় ছিলেন। তবে বিচারকগণ সক্রেটিসকে সুযোগ দেন। কিন্তু তিনি এত সামান্য জরিমানার প্রস্তাব করেন যে, বিচারক সভা তাতে অপমানিত বোধ করেন। ফলে হেমলক বিষপানের মধ্য দিয়ে এই মহাজ্ঞানীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা এবং কার্যকর করা হয়।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যা অভিযোগ ছিল
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের নাম জানে না- এমন মানুষ দুনিয়ার বুকে নেই বললেই চলে। বিশ্বে যত বড় বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রেটিস। জ্ঞান, শিক্ষা দিয়ে তিনি এথেন্সের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন।
তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর প্রিয় শিষ্য প্লেটো প্রচার করতে থাকেন গুরুর শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু দেশটির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সক্রেটিসের এ খ্যাতি মেনে নেয়নি। পছন্দ করেনি তাঁর শিক্ষা-দর্শন। তখনকার দিনের নীতিনির্ধারকরা অভিযোগ করেন, সক্রেটিস যুবসমাজকে বিপথগামী করছেন। এ অভিযোগে তাঁকে ঢোকানো হলো কারাগারে। কিন্তু এতেও তাঁকে থামানো যায়নি। তাই সিদ্ধান্ত হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার। অবশেষে তাই হয়। দেশ-বিদেশে সব মানুষই জানে, সত্য বলার অপরাধে হেমলক বিষপানে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড হয়। কী সেই সত্য? সত্যটা হলো মূর্তির বিরোধিতা। প্রতিমা, প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠায় প্রতিরোধ গড়া। সক্রেটিসের মৃত্যু প্রমাণ করে মাটি বা ইট-পাথরের ভাস্কর্য, ম্যুরাল নির্মাণ, স্থাপন মিথ্যা প্রতিষ্ঠারই নামান্তর। সোজাসুজি বলতে গেলে, মূর্তির স্বপক্ষশক্তি অসত্যের পক্ষভুক্ত। আর বিরোধিতাকারীরাই সত্যের পক্ষে। সক্রেটিস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন- শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষার মধ্যেই মানষের অন্তরে জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়। জ্ঞানের মধ্য দিয়ে মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তাঁর কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তখন সে আর কোনো পাপ করে না। সক্রেটিস এও বিশ্বাস করতেন, অজ্ঞতা থেকেই সব পাপের জন্ম।
যা বলে গেছেন সক্রেটিস
সত্যিকারের জ্ঞান : এথেন্সবাসীর মতে, দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির ডেলফিতে দৈববাণী হয়েছিল যে, সক্রেটিসই হচ্ছে জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, তখনই সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার পথে হাঁটতে পারবে যখন জানবে তুমি কিছুই জানো না। তাই সক্রেটিস জুরিদের উদ্দেশ করে বলেছেন, আমি প্রমাণ করতে চাইলাম অ্যাপোলোর মন্দির ডেলফির দৈববাণী ভুল। তাই আমি প্রথমে গেলাম রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে এবং দেখলাম যাদের সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী বলে মনে করা হচ্ছে তারাই সবচেয়ে বেশি মূর্খ। তখন আমি বুঝলাম, আমি তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী, কারণ আমি অন্তত এইটুকু জানি যে, আমি কিছুই জানি না। তারপর আমি কবিদের কাছে গেলাম এবং দেখলাম তারা জ্ঞানের সাহায্যে নয় বরং দৈবজ্ঞানীদের মতো অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্য রচনা করেন। তারা অনেক চমৎকার কথা বলেন কিন্তু যা বলেন তার কিছুই বোঝেন না। অথচ কবিরা মনে করেন তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। তারপর আমি গেলাম কারিগরদের কাছে। দেখলাম তারা অনেক কিছুই জানেন, যা আমি জানি না। যেমন- জাহাজ কিংবা জুতা তৈরি করা। কিন্তু কবিদের মতো তারা বিশ্বাস করেন, তাদের জানা বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- জুতা তৈরি করা। এ বিশ্বাস তাদের জ্ঞানী হতে বাধা দেয়। এসব কিছু দেখেশুনে আমি সিদ্ধান্তে এলাম যে, আসলে কেউই জ্ঞানী নয়- রাষ্ট্রপরিচালকরা নয়, কবিরা নয়, কারিগররা নয় এমনকি আমিও নই, যার সম্পর্কে ডেলফিতে দৈববাণী শোনা গিয়েছিল। কিন্তু আমি অন্তত এইটুকু জানি যে, আমি কিছুই জানি না। সক্রেটিস আসলে বলতে চেয়েছেন, নিজের বিশ্বাস ধরে আঁকড়ে রাখলে কখনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। তিনি যখন সবাইকে প্রশ্ন করতেন তখন সবাই নিজস্ব ধারণা মতে উত্তর দিত এবং সেই বিশ্বাসেই অটুট থাকত।
আত্মিক উন্নয়ন : জ্ঞান ও সত্যচর্চার মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন বা পরিচর্যা করাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন সক্রেটিস। তিনি বলেছেন, আমি এথেন্সের ছোট-বড় সবাইকে বলি, তোমরা তোমাদের শরীর বা অর্থের পেছনে ছুটো না। তোমাদের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধন। যত দিন সত্য ও জ্ঞানের খোঁজ না পাও তত দিন পর্যন্ত অর্থ, যশ ও প্রতিপত্তির কথা চিন্তা করো না। সততা অর্থ থেকে আসে না বরং সততাই অর্থ ও অন্যান্য ভালো জিনিসগুলো টেনে আনে। এটাই আমার শিক্ষা।
যদি এই মতবাদ এথেন্সের যুবসমাজকে কুপথে নেয় তবে আমি দোষী। যদি কেউ বলে আমি এসব ছাড়া অন্য কিছু শিখিয়েছি, তবে সে মিথ্যুক। সক্রেটিস স্পষ্টতই বলেছেন, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই আত্মার উন্নয়ন সাধিত হয়। আর প্রকৃত জ্ঞান পেতে হলে ইহজাগতিক লোভনীয় মোহ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্র হচ্ছে বিশাল ঘোড়ার মতো : ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে আদালতে যখন সক্রেটিসের বিচার হচ্ছিল তখন তিনি এথেনীয়দের উদ্দেশ করে বলেছেন, তোমরা যদি আমাকে দোষী সাব্যস্ত করো, তাহলে যারা আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন সেই দেবতাদের বিরুদ্ধাচরণ করে পাপ করবে। আমি একটি ডাঁশ মাত্র (এক প্রকার মাছি যা গরু, ঘোড়া ইত্যাদির রক্ত পান করে) যাঁকে দেবতারা এই রাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিশাল ঘোড়ার মতো, বিশাল বপুর জন্য এটি অলস ও মন্থর গতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে- হুল ফুটিয়ে এটা চাঙা করা। এ জন্যই সব সময় সব জায়গায় আমি তোমাদের আলোকিত করে জাগানোর চেষ্টা করি। তোমরা আমার মতো আর কাউকে এত সহজে খুঁজে পাবে না। অতএব আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি। এখানে নিজের উপযোগিতা তুলে ধরেছেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। তখনকার রক্ষণশীল সমাজের সংকীর্ণমনা মানুষেরা তাঁকে ধারণ করার উপযোগী ছিল না। তারা আধুনিক নিত্যনতুন চিন্তা গ্রহণ করতে পারত না। ফলে তারা সক্রেটিসকে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সক্রেটিস রাষ্ট্রকে একটি বিশাল ঘোড়ার ন্যায় তুলনা করেন এবং রাষ্ট্রকে চাঙা করার উপায় বোঝানোর চেষ্টা করেন। কুসংস্কার আর গোঁড়ামি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিলেন তিনি।
জ্ঞানেই পুণ্য অজ্ঞতায় পাপ
সক্রেটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হলো- জ্ঞানেই পুণ্য। এই নীতি অনুযায়ী ভালোকে জানা মানে ভালো কাজ করা। সক্রেটিস বলতেন, মানুষ খারাপ কাজ করে শুধু তার অজ্ঞতার জন্য। পৃথিবীতে শুধু একটিই ভালো আছে তা হলো ‘জ্ঞান’। আর একটিই খারাপ আছে, আর তা হলো অজ্ঞতা। যদি জ্ঞানেই পুণ্য লাভ হয় আর জ্ঞান অর্থ যদি হয় ভালো কাজ করা তাহলে একজন লোক কখনোই খারাপ কাজে নিজেকে জড়াবে না। যদি জড়ায় তাহলে বুঝতে হবে সে ভালোকে জানতে ব্যর্থ হয়েছে।
মৃত্যুভয়ও দমাতে পারেনি গ্রিসের মহানায়ককে
মৃত্যুকে কেউ এড়াতে পারে না। তাই সব সময় মানুষের মনে কাজ করে মৃত্যুভয়। তবে সক্রেটিস ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি নিজস্ব যুক্তি দিয়ে মৃত্যুভয়কে হার মানিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, মৃত্যুর স্বরূপ আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তা সত্য কিন্তু মৃত্যুর পরে কী হবে তাকে আমরা দুটি সম্ভাবনায় সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারি। সক্রেটিসের মতে, এগুলোর কোনোটাই ভীতিকর কিছু নয়। তিনি বললেন, হয় মৃত্যু একটি স্বপ্নহীন চিরস্থায়ী ঘুম, নয় নতুন আরেকটি জীবনের শুরু। এ দুটি ছাড়া আর কী হতে পারে! আর নতুন আরেকটি জীবনও সক্রেটিসের কাছে ভালোই মনে হয়েছিল। কারণ অবশ্যই পূর্বে গত হওয়া মানুষদের দেখা পাওয়া যাবে সেখানে। সক্রেটিস কল্পনা করতেন হেডিস নামক এক কল্পলোকের। যেখানে মানুষ পরকালে যাবে। যে জগৎটা অনেকটা এথেন্সের মতোই। কিন্তু এথেন্সে যেমন মানুষ তার দৈহিক রূপ নিয়ে বাস করত, এখানে মানুষ বাস করবে শুধুই মন হিসেবে। কারণ মৃত্যু যদি ঘুম না হয়ে আরেকটি জীবন হয়, সেই জীবনে তো আর আমাদের দেহ থাকা সম্ভব নয়। দেহের তো ইতোমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে, পড়ে আছে পৃথিবীতেই। অকাট্য যুক্তি। এভাবেই সারা জীবন যুক্তির মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করেন সক্রেটিস। মৃত্যু নিয়ে অনেকেই অনেক রকম কথা বলে গেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় হলো মৃত্যু। সক্রেটিস এটা বুঝেছিলেন যে, তাঁর দর্শনচর্চা করতে শুধু মন থাকাটাই যথেষ্ট হলেও যাদের দৈহিক কাজকর্ম করতে বেশি ভালো লাগে, তাদের নিশ্চিতভাবেই পরকাল ভালো লাগবে না। তাই তিনি বলেছিলেন, আমাদের পৃথিবীর জীবনে দেহের পেছনে সময় না দিয়ে মনের পেছনেই সময় দেওয়া উচিত। কারণ মনটাই অবিনশ্বর। আর এটা করতে পারলেই দৈহিক মৃত্যু আর আমাদের কাছে ভয়ংকর মনে হবে না, বরং মৃত্যুর চিন্তা আমাদের আনন্দিত করবে। এই মানসিকতার কারণেই সক্রেটিস মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। একটু ভেবে দেখলে কিন্তু যে কেউ বুঝবেন যে, সক্রেটিসের দর্শন হাজার হাজার বছর ধরে এখনো আলোচিত এবং আধুনিক। আর এ কারণেই সক্রেটিস হয়ে উঠেছেন বিশ্বসেরা দার্শনিক।
আড়াই হাজার বছর পর সক্রেটিস নির্দোষ
প্রাচীন গ্রিসের এই মহাজ্ঞানীর মৃত্যুর প্রায় আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো- মৃত্যুর ২৪১৫ বছর পর (২০১৭ সালে) গ্রিসের এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালতে পুনরায় এ বিষয়টি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। আদালত জানালেন, সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের শাসকরা সক্রেটিসকে যে শাস্তি দিয়েছিলেন তা কোনোভাবেই আইনসম্মত নয়। কেননা সক্রেটিস সেই ব্যক্তি, যাঁর জ্ঞানের মূলধন দিয়ে পরবর্তী ২ হাজার বছর ধরে উপকৃত হয়েছে পশ্চিমা দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। একই মামলার দুটি কাঠগড়া, মাঝখানে শুধু সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান। প্রথম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সক্রেটিস আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছিলেন। আর এ সময়ের আদালতে তাঁর পক্ষ নিয়ে লড়েন গ্রিসসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের নামজাদা আইনজীবীরা।
সক্রেটিক সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে সক্রেটিস সম্পর্কে নানা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে এলেও ১৯ শতকে প্রথম ‘সক্রেটিক সমস্যা’ শব্দটির পরিচয় ঘটে। সক্রেটিসের জীবন, তাঁর দর্শন ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসবিদরা যে সমস্যার সম্মুখীন হন তাকেই বলা হয় ‘সক্রেটিক সমস্যা’। সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল না থাকায় সৃষ্টি হয় মূল সমস্যা। সক্রেটিসের কয়েকজন অনুসারী তাঁর সঙ্গে কথোপকথনগুলো লিখে গিয়েছিলেন। ‘লোগোই সক্রাটিকো’ বা ‘সক্রেটিক অ্যাকাউন্টস’ নামে লেখাগুলো পরিচিত। এদের মধ্যে কেবল প্লেটো আর জেনোফোনের লেখাই পাওয়া যায়। উনিশ শতক পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রেটিসকে জানার অবলম্বন ছিল জেনোফোনের লেখা। তবে ফ্রেডরিখ শ্লেইয়ারম্যাসার তাঁর গবেষণায় দেখান যে, কেবল জেনোফোনের ওপর নির্ভর করে সক্রেটিস ও তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এর থেকে প্লেটোর লেখা সক্রেটিস সম্পর্কে অধিক স্বচ্ছ ধারণা পেতে সাহায্য করে। এর বাইরেও তিনি আরও একজনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি হলেন অ্যারিস্টোফেন। তাছাড়া প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও সক্রেটিস সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে যান।
তাঁর উক্তি
♦ ‘সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার প্রক্রিয়াটি তখনই শুরু হবে যখন আপনি জানবেন যে, আপনি কিছুই জানেন না।’
♦ ‘আত্মার উন্নয়ন না করে শারীরিক সুস্থতা অর্থহীন। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধনই মানুষের প্রথম ও প্রধান কাজ।’
♦ সক্রেটিসের দর্শনের মূল দিক হচ্ছে- যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান ধরে রাখা যদি কোনো ভুল না থাকে। আদালতে বিচারকদের সামনে তাঁর বক্তব্য ছিল- ‘তোমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে যে দেবতারা আমাকে পাঠিয়েছেন তাদেরই দোষী
♦ প্রমাণ করা হবে। আমি সদা সর্বদা মানুষকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছি। আমার মতো কে আছে? অতএব আমাকে মুক্তি দাও। এটা আমার আবেদন নয়, উপদেশ!’
♦ সক্রেটিসের শ্রেষ্ঠ দর্শন- ‘জ্ঞানই পুণ্য’
♦ বিচারকদের কাছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর সক্রেটিস বলেন, ‘অপরীক্ষিত জীবনের কোনো অর্থ নেই।’
♦ সক্রেটিসের দর্শনের আরেকটি দিক ছিল এমন যে, অন্যায় করার চেয়ে অন্যায় সহ্য করা শ্রেয়।