শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরানের গহীন ভিতর

শামীম আজাদ

পরানের গহীন ভিতর

সৈয়দ শামসুল হক \ জন্ম : ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

তার কথা মনে হলে মাথায় কোনো সমতল ভূমের ছবি আসে না। সে আগে থেকেই। নূরলদীনের সারা জীবনের পর থেকেই। মনে আসে কেবল উচ্চভূমি। আর মাথার উপরে এক ব্যাপক উচ্চতা। খোঁচা খোঁচা চূড়, যেখানে ঝোঁপের মধ্যে গোখরো মাথায় মণি নিয়ে ফণা তুলে আছে। তাকে মনে হলে আর মানুষের লাহান লাগে না। মনে হয় নানা রঙের মাপের ওজনের বস্তুর প্লাস্টিক পাথর প্রবাল পানসি নৌকা জাহাজের ইস্পাত মদের পেয়ালা সবই শিল্পের দাঁতে কুচুরমুচুর করে আঠা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যেন এক হলিডে ক্যানভাস। এখানে কানে গোঁজা পেলব ফুলটি যাস্ট গাছ থেকে টান মেরে লাগিয়ে দেওয়া নয়, অত্যন্ত নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ে কলমের ডগা অথবা নিদ্রাহীন রাতের কী বোর্ডের আঁকে ফ্রিলিগ্রির সূক্ষ্ম কাজে তৈরি। তার কাজ দেখলে দৃশ্যের অতিরিক্ত আমেজ আসবে বাতাসে দেখা যায় নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও চুম্বন।

হক ভাইকে সেই কোন কালে দেশে থাকার সময়ে আজ থেকে পঁচিশ বছরেরও আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার ‘জীবন এখন যেমন’ নামে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ প্রযোজিত ধারাবাহিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে তার একমাত্র কন্যা বিদিতাসহ আমন্ত্রণ করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল দর্শক তার এই অচেনা কন্যাকে ২০টি প্রশ্নের মাধ্যমে শনাক্ত করবেন। তিনি আড়ালে থাকবেন। বিদিতা কেবল হ্যাঁ কিংবা না বলতে পারবে। দুটি প্রশ্নের উত্তরে আড়ালের ব্যক্তিত্ব নারী নয় পুরুষ এবং তিনি শিল্পকলা জগতের কেউ নির্ধারিত হয়ে গেলে পরের ছটি প্রশ্নের কোনোটিতে বিদিতা হ্যাঁ ছাড়া না বলতে পারেননি। প্রশ্নগুলো যথাক্রমে ছিল তিনি কবিতা গান গল্প নাটক কাব্যনাট্য অনুবাদ চিত্রনাট্য কলাম লেখেন কিনা। ছবি আঁকেন কিনা। ভাস্কর্য করেন কিনা। রচনা লিখেন কিনা। নিজে পারফর্ম করেন কিনা। গল্প বলেন কিনা। টিভি উপস্থাপনা করেন কিনা... এর উত্তর হ্যাঁ হ্যাঁ আর হ্যাঁ। সে দিনের টিভি শোর আড়ালের ব্যক্তিত্ব এর সবই করেন। এবং এর কোনোটাই আধাখেচড়া করে করেন না। এমনকি পোশাকেও মহা ফ্যাশনদুরস্ত ও তরুণ। আহারে আধুনিক। শব্দে পৌরাণিক। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া শিল্প জগতে এর চেয়ে অদ্ভুত ঘটনা আর নেই। ছিল না।

তার কথা লেখা পড়লে এবং তার শিল্পরূপ অভিনিবেশ সহকারে দেখলে পৃথিবীর তাবৎ স্পর্শ হয়ে যায় শীতল শরবত। গুহা ভেঙে উঠে আসে প্রবল আঁচড়। সিরামিক হারায় স্মুথনেস আর পারিজাত হয়ে ওঠে পক্ষী। যা কিছু স্পর্শের তাও হয়ে যায় দৃশ্যের। যা কিছু দৃশ্যের তাতেও পাওয়া যায় গন্ধ।

আশির দশকের শেষে পদাবলী নামে দর্শনীর বিনিময়ে কবিগণের কবিতা আবৃত্তির সংগঠন হয় তার প্রদর্শনীর দিনে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করছিলাম আমি ও দিলারা হাফিজ। ভিতরে বসে ছিলেন হক ভাই, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, নির্মলেন্দু গুণ। প্রধান কাজগুলো করছিলেন রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী ও বেলাল চৌধুরী এরা। এই প্রথম আমাদের কবিগণের পারফর্ম করতে হবে। এই প্রথম টিকিট কেটেছেন মানুষ শুধু পড়া নয় পারফরম্যান্সও পাবেন বলে। ঢাকা শহরের সাংবাদিক ও সাহিত্যামোদিদের ভিড় লেগেছে। মঞ্চে পোডিয়ামের পেছন থেকে ধোঁয়া আসছে। সাউন্ড সিস্টেমে সেতার। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মাত্র ১০ মিনিট বাকি। বাইরে থেকেও উত্তেজনায় ঘেমে আমি ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছি চাকমাদের লাল শাল। গ্রিনরুমে উঁকি দিয়ে ঘাবড়ে গেলাম। সব কবিই নার্ভাস। পানি খাচ্ছেন, নিজের কবিতা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে ফানা হয়ে যাচ্ছেন, কেউ কেউ পায়চারি করছেন। ওদের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতাও সেলুটেইপ বন্ধ। কেবল হক ভাই জিন্স পরে এক কোনায় মৃদু হাসছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি স্নান সেরে ফুরফুরে চিত্তে বোটের ডেকে এসে চায়ের অর্ডার করেছেন।

তার সৃষ্ট কাব্য ‘পরানের গহীন ভিতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পঙিক্তমালা’ পাগল করেছে কবিতাপ্রেমীদের। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এ মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশের অতীতের আঘাত, বর্তমানের বর্জ্য ও ভবিষ্যতের আশা, ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষা। সাহিত্যের স্বাদে বাদামি বালুকণায় ঝাল পাওয়া যায়। সবাই হৃদয় খণ্ড করে রক্ত ঝরিয়ে লেখেন। কিন্তু তার ‘হৃৎ কলমের টানে’ যেন পাঠকের কলিজার থোড় প্লেটে উঠে কাঁপতে থাকত। সে আমাদেরই কাগজ অসাধারণ সাপ্তাহিক বিচিত্রায়।

কিংবদন্তি সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর কক্ষে যখন তিনি যেতেন, শাহাদত ভাই আমাদের এই উদীয়মানদের ডেকে নিতেন। আমরা তাদের কথোপকথনে যোগ দিতাম কী দিতাম না সেটা বড় কথা ছিল না। শাহাদত চৌধুরী বলতেন, শোন হক ভাই’র শব্দ চয়ন। দেখ শব্দটি জিহ্বা থেকে ফেলে দেওয়ার আগে কীভাবে রোল করেন। আর লক্ষ্য কর একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে কীভাবে কথা বলা যায়। এরকম একটি আড্ডায়ই কথা হচ্ছিল বিদেশি ভাষার ব্যবহার নিয়ে। শাহাদত ভাই হক ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা একজন মানুষ ভালোই বাংলায় কথা বলছে, হঠাৎ একজনকে দেখে বলে উঠল, নিকাল যাও হিয়াসে। অথবা টেল মি হাও আর ইউ? এটা কেন করে? যেন ভাষার ডাক্তার এসেছেন বিচিত্রায়। হক ভাই তখন বলেছিলেন, শাহাদত, এটা যে করে সে জ্ঞাতসারেই করে। করে তার প্রতি যখন এক রকমের ভাষায় একটা মনো টোনের সৃষ্টি হয়ে আছে। এবং হঠাৎ এই বিদেশি ভাষা তাকে তার সামাজিক অবস্থানের উপর উঠিয়ে দিচ্ছে। তবে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিকভাবে ঘটে যে, তা লক্ষ্য করার উপায় নেই। কিন্তু উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। তার বাচিক ভঙ্গি ও উচ্চারণ নামার জন্য হক পাঠশালায় ভর্তি হয়ে পাস করলে যেকোনো মানুষ শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন।

সৈয়দ শামসুল হক এ দেশে চলচ্চিত্রের সূচনাপর্বে সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেন। করেন অনেক তথ্যচিত্রের ও চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনা এমনকি সংগীত রচনাও। এ এমন চাষি শিল্পের মাঠে যেখানেই হাত দিয়েছেন ফলেছে সোনা।

‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না, বুবু মণির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা।’ শুনলে আমি চলে যাই আমার কৈশোরের শহর জামালপুর।

তাকে উভচর নয় শুধু সব্যসাচীও নয়, বলতে পারি বহুচর ও বৃন্দমেধাধারী। যেভাবে নিয়মনিষ্ঠ মানতেন তাতে যাওয়ার কথা ছিল না। আশি বছরেও প্রাণপ্রাচুর্য ও কর্মক্ষমতায় ছিল পূর্ণ যৌবন। তাই তার হাতে বিরিয়ানির টেবিলে এসে যেত তরল পিনাকোলাডা, লিপস্টিকের লালে স্ট্রবেরির মধুর নির্যাস। গানে ভেসে আসে টেরাকোটা। হে বাংলাদেশ তুমি তাকে আমাদের করে আমাদের জন্য বহু কিছু করে যেতে দিয়েছ তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর