আবু সাঈদের ফাইনাল পরীক্ষার খাতাটি দেখছিলাম। নম্বরপত্র জমা দিতে যাব- এমন সময় টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম আমার ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ তাকে গুলি করছে আর সে রাস্তায় পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। আবারও তাকে গুলি করে পুলিশ। এবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। পরক্ষণেই খবর পেলাম আবু সাঈদ আর নেই, সে শহীদ হয়েছে।
নিজেকেই তখন বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না, আবু সাঈদ আর নেই। এইতো সেদিন ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল করিডরে। আমাকে দেখেই বিনয়ী হাসির সঙ্গে সালাম দিল। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা, বরাবরই ভালো রেজাল্ট করাসহ নম্রভদ্র আর মার্জিত স্বভাবের ছিল সে। শুধু আমার ছাত্র হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ছিল বড় অসাধারণ। এমন ছেলের জুড়ি মেলা ভার। ওকে নিয়মিত ক্লাসে পেতাম। প্রায় সময় চুপচাপ ক্লাসের শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসত, কিন্তু কোনো রকম দুষ্টুমি করতে দেখিনি কখনো। আবু সাঈদকে আমি ছাত্র হিসেবে পেয়ে গর্ব বোধ করি। সে শুধু আমাদের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের গৌরব ও অহংকার। সে আমাদের জাতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আবু সাঈদ ছিল খুবই বিচক্ষণ ও তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। খুব সহজেই সবাইকে সংগঠিত করা, নিমেষেই আপন করে নিতে জানত সে। কত সাধারণ থেকেও ব্যক্তিত্বে ছিল সবার সেরা। কখনোই বেশি নম্বর পাওয়ার আশায় কোনো শিক্ষকের সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে দেখিনি। দেখা হলে বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিয়ে চলে যেত। আর্থিক সমস্যার জন্য অনেক ছাত্রই বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধাসহ নানা ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকে, কিন্তু আবু সাঈদ কখনোই সেই সহযোগিতা বা সুবিধা ভোগ করেনি। ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তার আত্মমর্যাদা বোধ ছিল অনেক বেশি। হয়তো সে কারণেই তার আর্থিক সমস্যার কথা কখনো আমাদের মাঝে প্রকাশ করেনি। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা আর টিউশনি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখেছি তাকে।
শুনেছি, আবু সাঈদের জীবনের স্বপ্ন ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া এবং সেটা মেধার ওপর ভিত্তি করেই। তাই যখন সে মেধার যুদ্ধে বৈষম্য দেখেছিল, সেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য বৈষম্য আর অনিয়মের বিরুদ্ধে নিজের বুক টান করে দাঁড়ায় হায়েনাদের সামনে। সেই হিংস্র হায়েনারা শেষ পর্যন্ত চালায় তার বুকে আর আবু সাঈদ নিজের মূল্যবান জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করার জাতি আমরা নই। আমি গর্বিত এমন একজন বীর শহীদের শিক্ষক হতে পেরেছি।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ