আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবস আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এ উপলক্ষে সাধুর হাট বসছে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়, লালনের আখড়াবাড়িতে। এ সাধুসঙ্গে সাধু-বাউল-ফকিররা যোগ দিচ্ছেন। আর মিলন মেলায় যুক্ত হচ্ছেন পর্যটক দর্শনার্থীরা। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গুরু-শিষ্যের সাধন-ভজন ও ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন।
‘অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, অহিংস’ লালন দর্শনের গানে মুখর এখন ছেউড়িয়া এলাকা। আখড়াবাড়ির বাইরে বসেছে তিনদিনের লালন মেলা। উৎসব চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। অনেক সাধু-ফকিরই এরই মধ্যে আখড়াবাড়ির ভেতরে অডিটরিয়ামের নিচে আসন পেতে বসেছেন।
প্রবীণ সাধু মোহাম্মদ আলী ফকির বলেন, প্রায় দু’শো বছর আগে ফকির লালন সাঁই এই ছেউড়িয়ায় দোল পূর্ণিমার তীথিতে সাধুসঙ্গ করতেন। গানে গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতেন। সেই রেওয়াজ মোতাবেক অধিবাস, বাল্যসেবা ও পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে এখনো এই দোল উৎসব হয়। পাশাপাশি ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক লালন সাঁইজির দেহত্যাগের পর থেকে যুক্ত হয়েছে আরেকটি অনুষ্ঠান। দৌল উৎসবের আদলে ১৩৪ বছর ধরে তিরোধান উৎসবেও সাধু-বাউলরা লালনকে স্মরণ করছেন। বসছে সাধু সঙ্গ। পয়লা কার্তিক ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় সব সাধু-গুরু আসন নিয়ে চা-মুড়ির সেবার মধ্য দিয়ে তিরোধানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। সন্ধ্যার এই আয়োজনকে বলা হয় অধিবাস। এটি দৈন্য দিয়ে শুরু হয়, সঙ্গে সাঁইজির নাম-কালাম ধরে প্রার্থনামূলক পদ-পদাবলী গান চলতে থাকবে।
পরদিন ১৮ অক্টোবর সকালে বাল্যসেবা ও দুপুরে পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে সাধুসঙ্গের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। এরপর কিছু সাধু চলে যাবেন। তবে উৎসব যেহেতু আরও একদিন থাকছে, সেই হিসেবে থেকে যাবেন অনেকেই। সাধুরা বলেন, এখানে সাধু-গুরুর ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে চরিত্র গঠন হয়। সবাইকে সত্যবাদী, জিহাদী, কষ্টসহিঞ্চু ও অল্পতেই তুষ্ট থাকার মতো চরিত্রবান হতে হবে।
বিশাল আখড়াবাড়ি ও বাইরের খোলা মাঠে সাধু-বাউলরা বৈঠকি ঢঙে বসেছেন। একেকটি বৈঠক থেকে গানে গানে লালনের বাণী প্রচার করা হচ্ছে। আর ফকির লালন সাঁইজি ও তার শিষ্যরা চিরনিদ্রায় শায়িত যেখানে প্রথা অনুযায়ী সেখানে ভক্তি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ভক্ত-অনুসারীরা। গুরু-শিষ্যের মিলন হলে দেখা মিলছে হাতে হাত রাখার অপূর্ব দৃশ্য। লালনের গুরুবাদী মানব ধর্মে মানুষ ভজতে বলা হয়েছে।
ফকির হৃদয় শাহ বলেন, এই পূণ্যধামে যতো আয়োজন আছে, তার মধ্যে সাধুসঙ্গই বড় বিষয়। সূচনা হবে পয়লা কার্তিক সন্ধ্যার গুরুকাজ দিয়ে। এর অষ্টপ্রহর পর পূর্ণ সেবা দিয়ে এটি শেষ হবে। এই সময়টিতে লালনের বানী, তার আকুতি, শ্রষ্টার সঙ্গে মেলবন্ধন ও সাধুর আবেশ নিয়ে যে সঙ্গটি হয়, এটি বরাবরই দেখতে একই রকম। কিন্তু এর মধ্যেও ভিন্নতা তৈরি হয় কতটুকু শিখতে পারলাম এবং ধরে রাখতে পারলাম তার মধ্য দিয়ে। হৃদয় শাহ বলেন, আমি মনে করি প্রতিবারের এই অষ্টপ্রহর জীবনের সেরা সময় পার করি।
এদিকে, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, উৎসবের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজ করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যা। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং করা হচ্ছে। তাছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যুক্ত করা হয়েছে।
আখড়াবাড়ির বাইরে লালন একাডেমীর মাঠে স্থায়ী মঞ্চে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিরোধান দিবসের তিনদিনের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্ঠা ফরিদা আখতার। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় অতিথি থাকবেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কবি ফরহাদ মজহার। এখানে তিনদিনই আলোচনা অনুষ্ঠান ও লালন সংগীতানুষ্ঠান চলবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই