আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য- বারবার আমরা স্বৈরাচারী শাসকের কবলে পড়ি, মানবাধিকার থাকে না, সুশাসনের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না, আর্থ-সামাজিক দুর্দশায় দিশাহারা হয়ে পড়ে আটাশি শতাংশ দেশবাসী। প্রচণ্ড-শক্তিধর দখলদার পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে, রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে মহান আত্মত্যাগে পাওয়া স্বাধীনতার এই দেশে আমাদের এই কী প্রাপ্য! স্বাধীনতা-লাভের আধা-শতাব্দী পার করেও আমরা মুক্তি-সংগ্রামের সব অর্জন কি বিসর্জনে দিলাম!
স্বৈরাচার এরশাদের পতনের প্রায় ৩৪ বছর পর আরেক স্বৈরতন্ত্রী তথা কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটল-বীর ছাত্র-জনতার অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে। প্রায় ৪০০ বা ততোধিক শহীদের রক্তে-রঞ্জিত রাজপথের বিপ্লবী-স্রোতে খড়কুটার মতো ভেসে গেছে কর্তৃত্ববাদীরা। আমাদের অভিবাদন বীর ছাত্রসমাজকে-যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে রাজপথে নেমেছেন, নিজেদের বুকের রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছেন। অভিবাদন সেসব শিক্ষক-অভিভাবক-নাগরিকদের যারা দেরিতে হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে নিজেরাও রাজপথে নেমেছেন। অভিবাদন সেসব সন্তানহারা মা-বাবাকে, ভাইহারা বোনকে, স্বামীহারা নারীকে, অন্য স্বজনদের। স্বজনহারা মানুষের শোকে সমব্যথী আমরা সবাই, সমগ্র দেশবাসী।
একটানা সাড়ে ১৫ বছরের বেশি সময়কালের আওয়ামী লীগ দুঃশাসনে বাংলাদেশের মানুষ ছিল কূলকিনারা-হারা। গণতন্ত্র-হারা, মানবাধিকার-হারা, চরম আর্থিক দুরবস্থায় আটাশি শতাংশ মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। একনায়কতন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকার হামলা-মামলা, গুম-গুপ্তহত্যা, প্রকাশ্য খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির মানুষকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়। জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলো ও তাদের রাজনীতিকরা, সুশীল নাগরিকরা এ সরকারের সব অপকর্মের বিরুদ্ধে সীমাহীন ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতাদর্পী শীর্ষ-নেতার সেদিকে কোনো নজরই ছিল না। সদ্য-বিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতাদের তো সুস্থবোধ-বুদ্ধি পুরো লোপ পেয়েছিল, তারা কর্তৃত্ববাদী-নেতা শেখ হাসিনার মোসাহেব, চাটুকার ও স্তাবকে পরিণত হয়েছিলেন। দেশের জনগণের মঙ্গল-চিন্তা কখনোই সুস্থ মাথায় করার ভাবনাতেই ছিলেন না তারা। বরং সবাই ব্যস্ত ছিলেন রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনের দ্বারা নিজ নিজ পকেট ভর্তি করে আখের গোছাতে।
ব্যাংকগুলোকে লুটে নিয়ে তারা খেলাপি ঋণের অঙ্ক বানিয়েছেন প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। শেয়ার মার্কেট থেকে জনগণের কষ্টের উপার্জনের ক্ষুদ্র বিনিয়োগের দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে মেরে দিয়েছেন শেয়ার-দস্যুরা। কালোবাজারি, চোরাচালানি ও মুনাফাখোর-মজুতদাররা নিত্যপণ্যের ব্যবসার নামে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লোকজনের লাখ লাখ কোটি টাকা ‘অবৈধ-মুনাফা’ লুটে নিয়েছেন, নিরীহ খেটে-খাওয়া মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছেন। ভেজাল ও রাসায়নিক মিশ্রিত ‘বিষাক্ত’ খাবার-পানীয় ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী দেশবাসীর ভোগে লাগিয়ে ভোক্তাদের শরীর-মন ভেঙে দিয়েছেন। অগণতান্ত্রিক সরকার দেশ-জনতার জন্য সামান্যতম সুশাসনও কায়েম করতে পারেনি। উল্টো চাঁদাবাজি ও ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়ে নিরীহ ও সৎ কর্মজীবী, শ্রমজীবী কোটি কোটি মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। আর ক্ষমতাধর নেতারা ও আমলা গোষ্ঠীর সদস্যদের অনেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছেন ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে। বিশেষভাবে ‘ইবলিশ মার্কা ঠিকাদাররা’ এক টাকার নির্মাণকাজ বা রাষ্ট্রীয়-কাজের কেনাকাটায় দশ-বিশ টাকা/মানে, ১ হাজার, ২ হাজার শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অপরিসীম লুণ্ঠন করেছেন। এসব দুর্নীতিবাজ সবাই নিজেরা ভোগবিলাস করেছেন সপরিবারে আর লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। সরকারের মদতপুষ্ট এসব লুটের টাকার পরিমাণ গত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্ততপক্ষে ৪০ লাখ কোটি টাকা (এখনকার মুদ্রামানে)। আর পাচার অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১২ লাখ কোটি টাকা বলে অভিজ্ঞজনদের ধারণা।
মোট কথা, দুঃশাসনে, দুর্ভোগে, এই দেশের আটাশি শতাংশ মানুষকে ‘নরকতুল্য জীবনযাপন’ উপহার দিয়েছিলেন নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। অপ্রয়োজনীয় মেগা-প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ‘মেগা-দুর্নীতির লুণ্ঠন’ চালিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের আঠারো কোটি মানুষের মাথার ওপরে বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপিয়েছে অসহনীয় মাত্রায়। এমনকি দেশি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের কর্মকাণ্ডে ঋণ নিয়ে জনগণকে আরও বেশি ঋণগ্রস্ত করেছেন। আর কালো টাকা অর্জনের সুযোগ দিয়ে ধনীকে আরও বেশি ধনবান করেছেন এবং গরিব মানুষকে আরও বেশি দরিদ্র করে ছেড়েছেন। শিল্পায়নে ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা মার খেয়েছে পতিত সরকারের হর্তাকর্তাদের পার্সেন্টেস বাজির কারণে। এর মধ্যেও কিছু সম্পদশালী ব্যক্তি দেশপ্রেমে, দেশবাসীর কল্যাণে, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে শিল্প-বিনিয়োগ, কৃষি-খামার বিনিয়োগ করে চলেছেন তাদের অবশ্যই অভিবাদন জানাই।
এখন কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসকের পতনের পরে জাতি-গঠনে, দেশের অর্থনীতি তথা সমাজ বিনির্মাণে এবং গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষকে বাঁচাতে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যত দ্রুত সম্ভব একটা প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কিছু কাজ শুরু করে দিতে হবে। তা না হলে জাতির ও রাষ্ট্রের আরও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
১. আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরের সব অপকর্মের তদন্ত অনুষ্ঠানে একটা বড় ধরনের কমিশন গঠন এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে জরুরি কাজ। অন্তত এগারো সদস্যের (আরও বড় হতেও পারে) এই কমিশন হতে পারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে, সদস্যরা হবেন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, হিসাববিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিকিৎসাবিদ, সাংবাদিক ও অন্য পেশার বুদ্ধিজীবী। এই কমিশন আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ দুঃশাসনের সার্বিক তথ্যাবলি অনুসন্ধান করে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করবেন। কমিশন সব অপকর্মের জন্য দায়ী প্রধান রাজনীতিকরা ছাড়াও তাদের সহযোগী সবশ্রেণির আমলা, ব্যাংকার (বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য সব ব্যাংকের উচ্চ-পদের কর্মকর্তা), আওয়ামী লীগ ও তার কর্তৃত্ববাদী সরকারের সহযোগীদের অর্থাৎ মোসাহেব, চাটুকার ও স্তাবকদের অপকর্ম তদন্ত করে রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করবেন এবং এ রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সব অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বিচারের আগে কাউকে নির্যাতন করা যাবে না, কারও বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা যাবে না। সেটা নিশ্চিত করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সর্বশ্রেণির শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা।
সব অপরাধী ও অনাচারকারী (সাম্প্রতিক আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপরে গুলিবর্ষণকারী ও হামলাকারী প্রতিটি লোককে) পালানোর সুযোগ না-দিয়ে সীমান্ত-এলাকা ‘সিলড’ করে আটকাতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জেলে ভরতে হবে। তাদের অনাচার ও অপরাধের তদন্ত সম্পন্ন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।
আইন পাস করে তাদের জামিন প্রদান নিষিদ্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের (ঝুঁকিপূর্ণ দশার লোকজন) মানুষজনকে, তাদের সম্পদ-সম্পত্তি ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শতভাগ নিরাপদ রাখতে হবে এবং মান-মর্যাদাসহ শতভাগ নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে। নতুন সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ দেশের প্রধান ধর্মাবলম্বী মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব সব ধর্মের মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক