মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি আমার দেশের দিকে। আমরা বলি সোনার বাংলা। আসলেই দেশটি সোনার। এ দেশের প্রাণশক্তি তরুণ সমাজ! বারবার তারা এ কথা প্রমাণ করেছে। মাত্র কিছুদিন আগে তাদের অমিত তেজ সবিস্ময় আর শ্রদ্ধায় আমরা দেখেছি! এখন আবারও দেখছি। বন্যা এদেশে নতুন নয়, বছর বছর বন্যা মোকাবিলা করি আমরা। প্রতি বছরই নব নব রূপে ধেয়ে আসে। নদীমাতৃক আমাদের দেশ। অসংখ্য নদী নালা খাল বিলের দেশ, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয় প্রচুর। তাছাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল বন্যা আনে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে দেওয়া বাঁধ খুলে দিলে একদিকে যেমন হয় বন্যা অন্যদিকে খরা। এ এক বহুকালের অমীমাংসিত বিষয়। বছর বছর এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হয়। কিন্তু ফলাফল বরাবরই গেছে আমাদের বিপক্ষে। দর কষাকষিতে বরাবর আমরা বঞ্চিতই হয়েছি।
এবারও আচমকা ধেয়ে এলো প্রবল বন্যা। এইতো মাত্র কয়েক দিন আগের কথা। বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হলো বাংলাদেশের নাম। পাকিস্তানে স্লোগান হলো- তুমি কে আমি কে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। ভারতে স্লোগান হলো- ঢাকা টু কলকাতা উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এর চেয়ে বড় জয় আর কী হতে পারে! বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে একটা উদাহরণ হয়ে দাঁড়াল। সেই জের কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হলো ভয়াবহ বন্যায়। বুঝে ওঠার আগেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল জনপদ গ্রামগঞ্জ। আচমকা কঠিন বিপদে নিপতিত আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ।
এবার বন্যার কারণ নানাবিধ। ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল এবং ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বর নদীর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া। এতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। গোটা দেশে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত অবশ্য এ কারণটি অস্বীকার করছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে- ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা এলাকায় কয়েকদিন ধরে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে। তাদের ভাষ্যমতে অতি বৃষ্টি এ বন্যার কারণ। কিন্তু বাঁধটি তারা সত্যিই খুলে দিয়েছে। খোলার আগে বাংলাদেশকে জানায়নি। বাঁধ গলিয়ে ঢলের মতো নামছে প্রবল জলস্রোত। এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আগাম সতর্কতা না জানিয়ে, আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বাঁধ খুলে দেওয়া অমানবিক আচরণ। উজানের পানি বাংলাদেশে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আমি আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের জনবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে। ভারতের এ নীতি নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও জনগণ ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণকে কীভাবে একত্রে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা যায়, সে বিষয় সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করতে হবে।’ তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করতে। তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করার আহ্বান জানান।
বন্যার কারণে কুমিল্লা ফেনী চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি নোয়াখালী মৌলভীবাজার হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। গণমাধ্যমে যে ছবিগুলো ছাপা হয়েছে সেগুলো হৃদয়বিদারক। গামলায় ভাসছে ছোট শিশু। গামলায় ভাসছে বিড়াল, কুকুর। ছোট্ট একটা শিশু আধগলা পানিতে জীবনের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুচোখে অসহায়ত্ব। ভেসে যাচ্ছে মানুষ বাড়িঘর মহিষ গরু ছাগল। জীবন বিপন্ন সাপ ইঁদুর বিড়ালেরও। কেউ আছেন গাছের ওপর, কেউ আছেন গলা পর্যন্ত ডোবা বাড়ির টিনের চালার ওপর। কেউ আছেন দোতলা বাড়ির ছাদে। সে দোতলা পর্যন্তও পানি উঠি উঠি করছে। কেউ গলা পর্যন্ত পানিতে সাঁতরে সামান্য মালামাল রক্ষার চেষ্টা করছেন। খাবার নেই, পানি নেই, পা রাখার জায়গা নেই। যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই তারা সামাজিক মাধ্যমে বাঁচার জন্য মেসেজ পাঠাচ্ছেন। মেসেজ পাঠাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা। কারও বৃদ্ধ মা একা আছেন বাড়িতে। এটা তো এখনকার সময়ের বাস্তবতা। তার সন্তান মেসেজ করে উদ্ধারকারীদের সহায়তা চাইছেন। কারও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আটকা পড়েছেন বাড়িতে, তিনি আছেন ছাদে। ঢাকায় চাকরিরত তার স্বামী স্ত্রীকে উদ্ধার করার জন্য সহায়তা চাইছেন মেসেজ করে। দুই বছরের শিশু বাবার হাত থেকে ছুটে একা হয়ে গেছে।
কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে অনত্র। খুলনার উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নড়াইলের কালিয়া এলাকাও বন্যাকবলিত। কিছু কিছু এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ফেনী এলাকার অবস্থা ভয়াবহ। বন্যায় উদ্ধার কাজে গিয়ে উদ্ধারকারী একজনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হয়তো আরও কেউ মারা গিয়ে থাকতে পারে। যা আমরা জানি না। বিভিন্ন স্থানে ২৩ জন মারা গেছে বলে জানা গেছে। শিশু বৃদ্ধরা ভেসে গেছে।
উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। সেনাবাহিনী নৌবাহিনী কোস্টগার্ড বিজিবিসহ অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী দল উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ছুটি বাতিল করা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। দুর্গত এলাকায় পানির তীব্র সমস্যা হওয়ায় ওয়াটার প্লান্ট খোলা হয়েছে। সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দুর্গত এলাকায় সার্বক্ষণিক নেট চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ শুরু হলেও ভয় কাটেনি। টাওয়ার মেরামতের কাজ করলেও পানির কারণে দ্রুত কিছুই করা যাচ্ছে না। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় উদ্ধারকারীদের এক জায়গা থেকে ছুটতে হচ্ছে অন্য জায়গায়। সাজেকে আটকা পড়েছিলেন ২৫০ জন পর্যটক। কেউ কেউ আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েছেন। পাহাড়ে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। আশ্রয় নেওয়ার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সব স্কুল-কলেজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পানি উঠে গিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ। অবশেষে তা চালু হয়েছে।
অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ত্রাণ কাজে এগিয়ে এসেছেন। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে বা দলবেঁধে উদ্ধার কাজে চলে গেছেন। সরকারের তরফ থেকে অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বন্যার সময় দেওয়া হয়। আমি যখন সরকারি চাকরিতে ছিলাম তখনো যে কোনো জাতীয় দুর্যোগে এক দিনের বেতন আমরা দিতাম, তাছাড়া নিজস্ব অর্থও দিতাম। এবারও অনেক কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের এক দিনের বেতন বন্যা তহবিলে দিয়েছেন। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার এক মাসের বেতন ডোনেট করেছেন। এসব স্বাভাবিক। আমি এ বিষয়ে বলতে চাই না। বলতে চাই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের কথা। এবারের বন্যায় আমরা যে চিত্র দেখছি আগে কখনো তা দেখিনি। দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ ত্রাণ কাজে অংশ নিয়েছেন। হাত খুলে বন্যা ত্রাণ তহবিলে দান করছেন। দেশের প্রতিটি মানুষ ভাবছে এটা আমার দেশ। আমার দেশে বন্যা হয়েছে। কাজেই বন্যা ঠেকাও, মানুষ বাঁচাও এই প্রতিজ্ঞায় এক হয়েছে প্রতিটি মানুষ। বরাবরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এগিয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল-কলেজের ছাত্রসহ সাধারণ মানুষ। টিএসসিতে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ চলছে। সেখানে ঢোকা যাচ্ছে না মানুষের ভিড়ে। পথে লম্বা লাইন পড়ে গেছে গাড়ির। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে। প্রত্যেকের মনে একই ভাবনা, এ দুর্যোগ জাতীয় দুর্যোগ, এ দুর্যোগ সবার। সবাই ভাবছে, ‘ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’। মার সন্তান মানে সবাই নিজের ভাইবোন। এই যে একাত্মতাবোধ এমনটা আগে ছিল না। প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি টাকা ফান্ডে জমা পড়ছে। ত্রাণসামগ্রী এত বেশি এসেছে যে রাখার জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। দিন-রাত পরিশ্রম করে আমাদের ভাইবোনেরা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। রাতের পর রাত জাগছে তারা। একের পর এক ট্র্রাকে করে ত্রাণসামগ্রী বন্যাদুর্গত এলাকায় যাচ্ছে। ট্রাকচালকরা ভাড়া নিচ্ছেন না, জ্বালানির পয়সা নিচ্ছেন না, ট্রলার, স্পিডবোটের মালিকরা ভাড়া নিচ্ছেন না। অনেকেই ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার দিয়েছেন উদ্ধার কাজে। এ এক অভূতপূর্ব জাগরণ! দেশের সর্বস্তরের মানুষ দুই হাতে টাকা দিচ্ছে এাণ তহবিলে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের হাত খরচের টাকা দিচ্ছে। ছোট ছোট শিশুরা তাদের জমানো টাকা দিচ্ছে। একজন শিশু ওমরা করার জন্য সাড়ে চৌদ্দ হাজার টাকা জমিয়েছিল। সে সেই টাকা দিয়েছে দুর্গতদের জন্য। গৃহবধূরা গহনা বানানো বা শাড়ি কেনার জন্য সংসার খরচ থেকে জমানো টাকা দিয়েছে। হিজড়া সম্প্রদায় ১ লাখ টাকা দিয়েছে। আলেমসমাজ টাকা দিয়েছে। ব্যান্ড শিল্পীরা টাকা দিয়েছে। সমাজের এমন কোনো অংশ নেই যারা এই ত্রাণ কাজে অংশ নেয়নি। সমস্ত সমাজ একাকার হয়ে গেছে।
ছেলেমেয়েরা রাত-দিন এক করে কাজ করছে। তারা প্যাকিং করছে, বস্তায় ত্রাণমামগ্রী ভরছে, ঠোঙ্গা বানাচ্ছে। হাজার রকম কাজ। দাতাদের নাম লিখতে হচ্ছে, হিসাব রাখতে হচ্ছে। প্রতিদিন দেশবাসীকে ফেসবুকে আপডেট দিতে হচ্ছে। ট্রাকে মালামাল তুলে দিতে হচ্ছে। ট্রাকগুলো চলে যাচ্ছে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। তারপর ট্রলার নৌকা বা স্পিড বোটে ত্রাণ যাচ্ছে দুর্গত এলাকায়।
বন্যা মোকাবিলার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এবারও আমরা বন্যা সামাল দিতে পারব আশা করি। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এই সমস্ত নদীর পানির হিস্যা এবং বাঁধ নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা হলেও কোনোদিন আমরা সুবিচার পাইনি। নতুন সরকারপ্রধান বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি এসব বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাবেন। তাঁর সঙ্গে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা দেখা করতে গেলে পানিবণ্টন ও বন্যার বিষয় যৌথভাবে কাজ করা যায় কি না এ বিষয়ে নিয়ে আলাপ করেন তিনি।
আমাদের আবহাওয়া দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে আরও সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। যাতে বন্যা আসার আগেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোরও সুরাহা করতে হবে। আমরা চাই, ন্যায্যতার ভিত্তিতে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা করে বিষয়গুলোর সমাধান হোক।
সবশেষে বলতে চাই, এবার এক নতুন বাংলাদেশ দেখলাম আমরা। এমন সম্প্রীতি এমন ভ্রাতৃত্ব এমন ভালোবাসার চিত্র অনেকদিন আমরা দেখিনি। একাত্তরে একবার দেখেছিলাম। আবার দেখলাম। জয় হোক বাংলাদেশের মানুষের। বেঁচে থাকুক আমার সোনার বাংলার মানুষ!
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক