তপ্ত গরম গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ঋতুতে যখন বৃষ্টিপাত প্রধানত শেষ বিকালে এবং সন্ধ্যার প্রথম দিকে পড়ে, এমন ভেজা সময়ে বাতাসের গুণমান তাজা ও উন্নত হয়। গাছপালা বেড়ে ওঠে। মৌসুমের শেষ দিকে ফসলের ফলন হয়। নদীগুলোর তীরে উপচে পড়ে এবং সরীসৃপ জাতীয় কিছু প্রাণী উচ্চভূমিতে ফিরে যায়। মাটির বল হ্রাস পায় এবং ক্ষয় বৃদ্ধি হয়, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বর্ষা শেষের ভেজা এমন মৌসুমে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, কারণ ফসল তখনো পরিপক্ব হয়নি। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এমন ভেজা অথচ তপ্ত ঋতুর প্রতিশব্দকে শরৎ বা মনসুন বলা চলে।
এবারের শরতের শুরুতেই এ বাংলাদেশে ঘটে গেল এক বিরাট ঘটনা। দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা ঝড় নয়- দেশের মধ্যখানে রাজধানী ঢাকায় ছাত্ররা গর্জে উঠল, গুমরে থাকা ক্ষোভ-বেদনা-দুঃখ-অপ্রাপ্তি, তীব্র ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে দিল। দীর্ঘদিনের জমে থাকা রাগ-ক্ষোভ-অভিমান সপ্তাহেরও কম সময়ে উড়িয়ে দিল ধূলি-ময়লা পাথরকণাসহ সব আবর্জনা। উড়িয়ে নিয়ে গেল আয়নাঘর আর ক্রসফায়ার। আয়েশি সাবধানী মধ্যবিত্ত নেমে এলো রাজপথে। দৌড়াতে দৌড়াতে মিছিলের পিছু নিল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এক নতুন ভোর নিয়ে এলো প্রত্যয় আর আশা জাগানিয়া বাংলাদেশ। প্যারিস থেকে উড়ে এলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। জনতার মনে এক সাগর আশা-জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ।
দুই মাস হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা বিপ্লব করে আগাপাছতলা পাল্টাতে না চাইলেও আপাতত কাঠামোগত সংস্কার চাইছে। অন্তর্বর্তী সরকারও কাজ শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে দু-এক লাইন বাড়তি কথা বলে নিজেদের অহেতুক সমালোচিত করে তুলছে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আঙুল খুলে নেটিজেনরা লিখছে। রাজনীতিবিদরাও সকাল-বিকাল নানান কথা বলছেন, এসব এ দেশে নতুন। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার ভাব চারদিকে। তবু নিত্যপণ্যের প্রতিদিন বাড়তি দর। কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না ১০০ টাকার নিচে। প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৭৫ টাকায় উঠেছে। আর কতদূর দ্রব্যমূল্য বাড়বে বা নতুন কাজ কি জুটবে, আগামীকাল কী হতে পারে- এমন উদ্বেগ আর কষ্ট নিয়ে সাধারণ মানুষ এখন রাতে ঘুমাতে যায়, তবে ঘুম থেকে ওঠে সে যখন বোঝে দেশের ক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে, তখন এক প্রকারের মন সুখ-শান্তি নিয়ে আরেকটি কঠিন দিনের সংগ্রাম যাত্রা সে শুরু করে।
প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্তিগত ক্যারিশমা আর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ দিয়ে বিশ্ববাজার থেকে নতুন ধার এনেছে। দেশের জাতীয় ঋণ বেড়েছে। তবু আপাতত বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কিছুটা ভারী হয়েছে, পাওনাদারেরা শান্ত হয়েছে। কিন্তু শিল্প-বাণিজ্যে প্রাণ ফিরে আসছে না। সবাই বোধহয় বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। সরকারি অফিসে ঘুষখোরেরা আগের মতোই আছেন বহাল তবিয়তে।
পরিবর্তন উনাদের কাছে খোশগল্প মাত্র। এইচ এস কোড চক্করে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প উঠবস করছে। ঘুষ খাওয়া এবং দেওয়া বোধহয় আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৪ শতাংশ। প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগের এ সময় কোনো ব্যবসায় এমন হারে মুনাফা হতে পারে? সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দল ৬১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু অর্থনীতি বা শিল্প ব্যবসার সংকট কাটানো নিয়ে কিছুই বলেনি। শুধু রাজনৈতিক সংস্কার করে কি সাধারণ মানুষের জীবনে গুণগত পরিবর্তন আসবে? এক্ষণে আমাদের শিল্প-বাণিজ্যের চাকা যদি পুরোদমে না ঘোরে তাহলে এমন টানাটানি করে কীভাবে চলবে। বৃহত্তর ব্যবসায়ী সমাজ যারা গত প্রায় এক যুগ কতিপয় তন্ত্রের দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছিল তাদের পথ দেখিয়ে উঠিয়ে আনতে হবে। বল-ভরসা দিয়ে আবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আটকে পড়া ঋণ বিনিয়োগের গুণমান ব্যবসার নগদ প্রবাহ বা ক্যাশফ্লো ইত্যাদি বিবেচনা করে নতুন নীতিসহায়তা দিতে হবে, তবেই না কর্মসংস্থান আর রপ্তানি বাড়বে। অগ্রাধিকার দিতে হবে শিল্পের চাকা ঘোরানোর দিকে। পেছনে হাত ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো তরুণ তুর্কির দলকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আদিকালের কৌশল। এখন ভাবতে হবে সাধারণ মানুষের আয় আর রপ্তানি বাণিজ্য বাড়িয়ে মুদ্রাকে মজবুত করার চিন্তা। নতুন বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সাহস করে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে, তাকে সম্মান দিতে হবে। আইএমএফের প্রেসক্রিপশন কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য দর্শনের বাস্তব রূপ দিতে হবে, নতুন বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে চাকরিপ্রার্থী নয় চাকরিদাতা হতে হবে। সুনামি জলোচ্ছ্বাস পরবর্তীতেও আবার জেগে উঠতে হয় মানুষ এবং দেশকে, তবেই পৃথিবী ফলাফলে ভরে ওঠে। ধ্বংসস্তূপ থেকেই নতুন ইমারত তৈরি হয়।
লেখক : বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাবেক পরিচালক এফবিসিসিআই