শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাড়ছে জমির বহুমুখী ব্যবহার বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য

গোলাম রাব্বানী

বাড়ছে জমির বহুমুখী ব্যবহার বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য

কৃষি জমির বহুমুখী ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে দেশ। বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। গড়ে উঠছে কৃষি নির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার ১০ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি বা দুটি ফসল হতো। বর্তমানে সেই জমিতে তিন থেকে পাঁচটি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। আবার একই জমিতে একসঙ্গে কয়েকটি ফসলও চাষ করা হচ্ছে। ধান চাষের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল যেমন ডাল, তেল, মশলা ও নানা অর্থকরী ফসলের চাষ করছেন কৃষক। এভাবে জমির বহুমুখী ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য।

কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী— পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলে ফল চাষের সঙ্গে সবজিও চাষা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আম ও লিচুর বাগানে আদা, হলুদ, ঢেঁড়স ও অন্যান্য সবজি একই সঙ্গে চাষ করা হচ্ছে। কৃষিবিদরা মনে করছেন—সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী যৌথ প্রয়াসেই এমন সাফল্য এসেছে। পাশপাশি বাংলাদেশে নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এরমধ্যে হাইব্রিডসহ খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাতও রয়েছে।

জানা গেছে, দেশে কৃষি পরিবার এক কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩। মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ পাঁচ হাজার ২৭৮ হেক্টর। এক ফসলি জমি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৯ হেক্টর। দুই ফসলি জমি ৩৮ লাখ ২০ হাজার ৬৩৭ হেক্টর। তিন ফসলি জমি ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬২ হেক্টর। নিট ফসলি জমি ৭৯ লাখ আট হাজার ৭৭১ হেক্টর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী—২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে মোট দানাদার শস্যের (চাল-গম-ভুট্টা) উৎপাদন হয়েছে ৩৯১.০৩ লাখ মেট্রিক টন, ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন হয়েছে ৯.৩৯৬ লাখ মেট্রিক টন, আলু উৎপাদন হয়েছে ৯৪.৬৪ লাখ মেট্রিক টন, পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২১.৩০ লাখ মেট্রিক টন এবং পাটের উৎপাদন হয়েছে ৭৫.৬০ লাখ বেল। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে মোট দানাদার শস্যের (চাল-গম-ভুট্টা) উৎপাদন হয়েছিল ৩৮৫.১৮ লাখ মেট্রিক টন, ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন হয়েছিল ৮.৯৩ লাখ মেট্রিক টন, আলু উৎপাদন হয়েছে ৯২.৫৪ লাখ মেট্রিক টন, পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে ১৯.৩০ লাখ মেট্রিক টন এবং পাটের উৎপাদন হয়েছিল ৭৫.০১ লাখ বেল। ফলে ২০১৪-১৫ এর তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দানাদার শস্যসহ অন্যান্য ফসলের মোট উৎপাদন বেড়েছে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে মোট উৎপাদিত ধানের ৫০ শতাংশই আসে ক্ষুদ্র কৃষকের কাছ থেকে। তিন দশক আগে ১৯৮৮ সালে এক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। সাম্প্রতিক গবেষণার হিসাবে এর মধ্যে ১ কোটি ৭৭ লাখ টনই উৎপাদন করেছেন ক্ষুদ্র কৃষক।

উৎপাদনে নীরব বিপ্লব : দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। চার দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। দেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক-সবজি রপ্তানি করে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও ওষুধশিল্পে বর্তমানে ১০০ ধরনের ওষুধ উদ্ভিদ থেকে দেড় শতাধিক ওষুধ উৎপাদন হয়। কৃষিজ উৎপাদনে সফলতায় বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে নতুন আশার সৃষ্টি করছে।

এদিকে দেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ জনমানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এবং বাকি সব পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৯.৪১ ভাগ এবং দেশের শ্রম শক্তির ৪৭.৫ ভাগ কর্মসংস্থান হয় কৃষি খাতে। জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতো গুরুত্ব্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে দেশের সামাজিক অর্থনীতি তথা আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।

পৃথিবীর মধ্যে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটারে লোক সংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৭ হাজার নতুন মুখ। বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ লোক। অন্যদিকে রাস্তা ঘাট, মিল কারখানা, স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান, ইটেরভাটা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি হতে ১ ভাগ হারে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসাবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। বর্ধিত জনসংখ্যার ক্ষুধার চাহিদা মিটাতে পাল্লা দিয়ে নিবিড়ভাবে চাষ করা হচ্ছে ধান আর ধান। যদিও পৌনে চার কোটি মেট্রিক টন উৎপাদনে দানাদার ফসলে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদন : নতুন নতুন জাতের ও প্রচলিত জাতের ফলের বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাহাড়ি এলাকার পতিত জমি ফল চাষের আওতায় আনতে কাজ করছে সরকার। এ ছাড়া পুরাতন বাগান পরিচর্যার মাধ্যমে উন্নত করা, বসতবাড়ির পরিত্যক্ত জমিকে ফল চাষের আওতায় আনা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে নারিকেল চাষ সম্প্রসারণসহ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ১৭টি জেলার ৬৭টি উপজেলায় কমলা, মাল্টাসহ অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের চাষ বৃদ্ধি, উন্নয়ন, উন্নত জার্মপ্লাজম সংগ্রহ এবং সম্প্রসারণের ‘সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ নেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলার আপেল নামে পরিচিত স্বরূপকাঠির পেয়ারা দিয়ে উন্নতমানের জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিশ্বের কয়েকটি দেশ পর্তুগাল, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে রপ্তানি হচ্ছে।

কৃষির বহুমুখীকরণের উদ্যোগ : আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের উচ্চমূল্য ফসল চাষাবাদে সম্পৃক্ত করতে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষির বহুমুখীকরণ ও নিবিড়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং গ্রামীণ যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য কৃষি সহায়ক’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এরপর মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় চার গুণ। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য রেকর্ড ছুঁয়েছে। ইতিমধ্যে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর