দেশকে তুলে ধরার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। সম্পূর্ণ নতুন একটি টিম নিয়ে নতুন একজন অধিনায়ক কতদূর যেতে পারবেন, প্রশ্ন ছিল সেখানে। মঞ্চের পর্দা নামার পর এরই মধ্যে সে প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ছোট্ট একটি টিম নিয়ে যে পারফরম্যান্স দেখালেন, তা মনোযোগ কেড়েছে সবার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী নেতা ও সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আয়তনে ছোট হলেও তাঁর লক্ষ্য ছোট নয়। দেশের ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত দিয়ে যে অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে তার মূল্য অসীম।
অভ্যুত্থানের পর তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সরকারের লক্ষ্য একটাই, তা হচ্ছে- বৈষম্য, দুর্নীতিমুক্ত একটি নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠন। প্রতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। নিউইয়র্কে সংস্থাটির সদর দপ্তরে সারা বিশ্বের সব দেশের নেতারা বৈঠকে বসেন। তাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অভিজ্ঞ ও ঝানু রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিকরা সেখানে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশ থেকেও ছোট্ট একটি দল নিয়ে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সঙ্গে ছিলেন দুই উপদেষ্টা, একাধিক বেসরকারি ব্যক্তিত্ব, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, বিশেষ সহকারী এবং আন্দোলনকারী ছাত্র প্রতিনিধি। এদের নিয়েই টানা তিন দিন জাতিসংঘের মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ালেন তিনি।
সেই মঞ্চে তিনি শুধু বিগত ১৫ বছরের ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের কথাই তুলে ধরেননি, একই সঙ্গে দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার একাত্ম হয়ে যে রক্ত¯œাত গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে- তুলে ধরেছেন তাঁর সচিত্র ইতিহাস। বিশ্ব নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, রক্তে ভেজা রাজপথ আর আইল্যান্ডে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কচি হাতে আঁকা নানা রঙের, নানা বর্ণের, নানা স্লোগানের দেয়ালচিত্র ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’। অভূতপূর্ব এই অভ্যুত্থানের নায়কদের তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব নেতাদের সামনে। বলেছেন তাঁদের আকাক্সক্ষার কথা। জানিয়েছেন সব ধরনের বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাঁদের অবদানের কথা। জাতিসংঘে ভাষণেও ড. ইউনূস তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞানেরও প্রমাণ রেখেছেন। তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ও তরুণ প্রজন্মের লক্ষ্য তুলে ধরার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও কথা বলেছেন। যুদ্ধ যে কোনো সংকট সমাধানের নিয়ামক নয় সে কথাও তুলে ধরেছেন। ফিলিস্তিনের বর্তমান বাস্তবতা শুধু আরব বা মুসলমানদের জন্যই নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সংলাপের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ড. ইউনূস রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংস্কার সংক্রান্ত জাতীয় ইস্যুর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে। এই সমস্যা সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, চীন, ভারতের মনোযোগ আকর্ষণ ছাড়াও তিনি তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। রোহিঙ্গা সমস্যাটি যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট মনযোগ দাবি করে এটিই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকে মিলিত হওয়া। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলছে, এটি ছিল একটি বিরল বৈঠক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধানের সঙ্গে এ ধরনের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকের নজির নেই। এবারই প্রথম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান বৈঠক করলেন। আর এই বৈঠক ঘিরে শুধু বাংলাদেশ নয়, আঞ্চলিক এবং এশীয় অঞ্চলের বাইরে দূর-পশ্চিমের অনেক দেশের আগ্রহ ছিল লক্ষণীয়।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলানি, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা প্রমুখের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ছাড়াও তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করেন। অধিবেশন চলাকালীন সময়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোজা গ্রিটস, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃত্থিরাজসিং রুপুন, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জোর সঙ্গে মিলিত হন। রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান, কূটনীতিক ছাড়াও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাংগা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এমডি ক্রিস্টিালিনা জর্জিয়েভা, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার ভলকার টার্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) চিফ প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, ইউএস সিনেটর ডিক ডারবিন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক গিলবার্ট হাংবো, বিশ্বখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসির সিইও নুয়েল কুয়িন, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপ, শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রমুখ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ, যেখানে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ড. ইউনূসের পাশে থাকার ঘোষণা দেন গুতেরেস। সংস্কার কার্যক্রমে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার নতুন অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে মানবাতবিরোধী কার্যক্রমের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার কথা বলেন আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিউইয়র্কে ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল সভাতেও অংশ নেন তিনি। জাতিসংঘ অধিবেশনের বাইরে প্রফেসর ইউনূসের যে অনুষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল সেটি হলো ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডার্স স্টেজ’। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপ্রতি বন্ধুবর বিল ক্লিনটনের আমন্ত্রণে প্রফেসর ইউনূস ওই অনুষ্ঠানে যান। আর সেখানে তিনি মঞ্চে ডেকে নেন বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের পরিকল্পকদের দুজনকে। ড. ইউনূসের আহ্বানে তখন মঞ্চে ওঠেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে তাঁর বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি। প্রফেসর ইউনূস এই তরুণদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, তরুণরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছেন। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে তরুণদের বাংলাদেশ।