বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে গঠিত কমিশনের কার্যক্রম শুরুর পর ১৩ কর্মদিবসে ৪০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। ঢাকার বাইরে থেকেও এসেছে অনেক অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী সরেজমিন পরিদর্শনে ‘আয়নাঘরের’ সন্ধান পেয়েছে কমিশন। সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে কমিশন। গতকাল রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
অনুসন্ধান কমিশনের সভাপতি হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যারা গুম হয়েছেন তাদের অভিযোগগুলো নিয়েই আমরা কাজ করেছি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা এবং অনুরূপ যে কোনো বাহিনী বা সংস্থার কোনো সদস্য বা সরকারের সহায়তায় বা সম্মতিতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি কর্তৃক ‘আয়না ঘর’ বা যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত স্থানে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত করা ও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরও আমরা ডাকব। বক্তব্যের জন্য সমন দেব। অভিযুক্তরা না এলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমদ শিবলী, মো. নূর খান, ড. নাবিলা ইদ্রিস এবং মো. সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিন পরিদর্শনে আয়নাঘরের সন্ধান পেয়েছেন জানিয়ে মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে গিয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান পেয়েছে কমিশন। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলটি (জেআইসি) ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের ভিতরেই। দোতলা ওই ভবনে ২২টি সেল আছে। ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর পরিদর্শন করেছি। ১ অক্টোবর আমরা ডিবি ও সিটিটিসি পরিদর্শন করেছি। তবে সেখানে কোনো বন্দি আমরা পাইনি। সম্ভবত ৫ আগস্টের পর সেখান থেকে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কমিশনের সভাপতি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। ৭৫ জন সশরীরে এসে তাদের বিবৃতি দিয়েছেন। অনেকে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন, অনেকে ইমেইলে দিয়েছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় ছিল। এই সময়সীমা ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে অভিযোগ নেওয়ার সময়সীমা আরও বাড়ানো হবে। তিন মাসে তদন্ত শেষ হবে কি না সেটা সামনে বোঝা যাবে।
৪০০ অভিযোগের মধ্যে অনেক ঘটনাই প্রথম সামনে এসেছে জানিয়ে কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, এসব ঘটনায় এর আগে কেউ কখনো গুম নিয়ে কথা বলেননি। থানায় তাঁদের জিডিও নেওয়া হয়নি। আমরা সবাইকে কমিশনে আসতে আহ্বান জানাই। কেউ আসতে না পারলে ডাকযোগে বা ইমেইলেও অভিযোগ পাঠাতে পারেন। আমরা সেগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখব। কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ভিজিটের সময় আমরা ডিজিএফআইয়ের যে আয়নাঘর দেখেছি, তার সঙ্গে ভুক্তভোগীদের বর্ণনার মিল পেয়েছি। তবে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ (এভিডেন্স) তারা নষ্ট করেছে। দেয়ালের লেখাগুলো পেইন্ট করে মুছে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের জানিয়েছি যেন যে অবস্থায় আমরা আয়নাঘর দেখে এসেছি, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো পরিবর্তন যেন না হয়। কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, প্রতিটি অভিযোগ আমরা শুনতে চাই। কী হয়েছিল তা জানতে চাই। কীভাবে আইন না মেনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তা বুঝতে চাই। গত ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে এ কমিশন গঠন করে সরকার। ১৫ সেপ্টেম্বর সংশোধিত এস. আর. ও. নম্বর ৩১২-আইন/২০২৪ নম্বর গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।