বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হাজারো সমস্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফরহাদ উদ্দীন

হাজারো সমস্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আবাসন সংকট, ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার, ছাত্র সংসদ অকার্যকরসহ নানা সমস্যা বিরাজ করছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে গণপরিবহন। আবাসিক হলগুলোতে প্রায়ই ঘটছে চুরির ঘটনা। রয়েছে ভিক্ষুক-যন্ত্রণা। দোয়েল চত্বর, পলাশীসহ বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে ছিনতাই-চাঁদাবাজি। দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করলেও এসব সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

আবাসন সংকট : প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাবির শিক্ষার্থী ছিল ৮৭৭ জন। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়লেও সে হারে বাড়েনি আবাসন সুবিধা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনযাত্রায়।

আবাসন সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো হয়ে উঠেছে জনবহুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্বাস্তু শিবিরের পরিবেশকেও হার মানায়। বিভিন্ন হলে সৃষ্টি হয়েছে গণরুম। অস্বস্তিকর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হল প্রশাসনের তদারকির অভাব। এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা। ছেলেদের হলগুলোতে হল প্রশাসনের ‘বিকল্প প্রশাসন’ চালান ছাত্রনেতারা। হলে ছাত্র ওঠানো থেকে নামানো সব তদারকিই তাদের। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রধান সমস্যা আবাসন সংকট। আর আবাসন সংকটের কারণেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আবাসন সংকট একটি বাস্তবতা। এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। কিন্তু জমি ও অর্থের অভাবে এটি দ্রুত নিরসনের সুযোগও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮টি আবাসিক হল ও দুটি ছাত্রাবাস রয়েছে। সম্প্রতি ছেলেদের জন্য এক হাজার আসনবিশিষ্ট ‘বিজয় একাত্তর’ চালু হয়েছে। সবগুলো হল মিলিয়ে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা হলেও বাকি অর্ধেক শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসন সংকট কিছুটা নিরসন করে তার চেয়ে বেশি হারে ভর্তির আসনসংখ্যা বাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন হলের আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। আবার যারা আবাসিক হলে অবস্থান করছেন তাদের থাকার পরিবেশ অত্যন্ত শোচনীয়। বিভিন্ন হল ঘুরে জানা যায়, আবাসিক হলের যেসব রুমে চার থেকে আটজন করে থাকা যায়, সেখানে ১৫ থেকে ২০ জনকে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা হলগুলোর মসজিদের বারান্দা, রিডিং রুম, হল সংসদ রুম, টিভি রুম ও পত্রিকা রুমে রাত কাটাচ্ছেন। হলে আসন না পেয়ে তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে অন্তত ১৬টি, এএফ রহমান হলে পাঁচটি, জহুরুল হক হলে ১০টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে আটটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে নয়টি, কবি জসীম উদ্দীন হলে ১১টি, হাজি মুহম্মদ মুহসীন হলে ১৩টি, রোকেয়া হলে দুটি, কুয়েত মৈত্রী হলে চারটি ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে তিনটি গণরুম রয়েছে। এসব রুমের একেকটিতে গাদাগাদি করে থাকছেন ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী। ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার : প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর পরিবর্তন হচ্ছে অনেক কিছু। তবে ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটেনি আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিনের খাবারের মান। কিন্তু প্রতিবছর বাড়ানো হয় খাবারের দাম। ক্যান্টিনের সেই হাত ধোয়া পানির মতো পাতলা ডাল আর অপরিষ্কার খাবার খেয়ে দিনাতিপাত করছেন আবাসিক হলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। প্রশাসনের উদাসীনতা, নেতাদের ফাউ খাওয়া, ক্যান্টিনে ভর্তুকির অভাবসহ নানা কারণে খাবারের দাম বাড়লেও মান বড়াছে না বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যান্টিনের কর্মচারীরা জানান, বর্তমানে ভাত ও মুরগি বা  গরুর মাংস ৩৫-৫০ টাকায়, ভাত ও মাছ ৩০-৪০ টাকায়, ভাত ও ডিম ২৮-৩৫ টাকায়, সবজি ৫ টাকায়, খিচুড়ি বা পোলাও প্রতি প্লেট ৩৫-৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ঢাবি শিক্ষার্থী পিয়াল হাসান বলেন, প্রতিবছর দাম বাড়ানো হলেও খাবারের মান আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ইতিমধ্যে ক্যান্টিন ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনের খাবারের দামের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। নিম্নমানের এসব খাবার খেয়ে বদহজম, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

ডাকসু অকার্যকর : প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাবি দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) থেকে। কিন্তু দীর্ঘ দুই যুগ ধরে কার্যকর নেই দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট খ্যাত এ রাজনৈতিক সূতিকাগার। স্বৈরশাসনামলে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ‘৯০-এর পর গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলের দীর্ঘ ২৫ বছরে হয়নি এ নির্বাচন। সরকারের কর্তৃত্ব হারানোর ভয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সরকারের প্রতি মেরুদণ্ডহীন আনুগত্যের কারণে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরও সচল হচ্ছে না ডাকসু। ফলে স্থবিরতা বিরাজ করছে ছাত্ররাজনীতিতে। গড়ে উঠছে না মেধাবী ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।

মাদকাসক্তি : সম্প্রতি ঢাবিতে মাদকাসক্তির পরিমাণ বেড়েছে। ক্যাাম্পাহ-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কেন্দ্র করে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল, মুহসীন হল, জগন্নাথ হল, ফজলুল হক হলসহ কয়েকটি হলের ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে চলছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক সেবন ও বিক্রি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি কর্মচারী ক্লাব জুয়াখেলা ও মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে জানা গেছে।

গণপরিবহন : এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে কোনো গণপরিবহন চলাচলের নিয়ম না থাকলেও এখন সব ধরনের পরিবহন ক্যাম্পাস হয়ে চলাচল করছে। এ বাসগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলাচল করে। ফলে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা।

ভিক্ষুক যন্ত্রণা : ক্যাম্পাসে ভিক্ষুক-যন্ত্রণায় রীতিমতো অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত নাছোড়বান্দা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এসব ভিক্ষুক। ভিক্ষার ছলে শিক্ষার্থীদের এক ধরনের জিম্মি করে টাকা আদায় করে তারা। টাকা না পেলে অনেক সময় খারাপ আচরণ করে। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন অন্তত কয়েকশ’ ভিক্ষুকের আনাগোনা রয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। ভিক্ষুক-যন্ত্রণার সঙ্গে রয়েছে ফুল, চকলেট ইত্যাদি বিক্রির নামে পথশিশুদের উৎপাত। এ ছাড়া টিএসসি, কার্জন হলসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ছিন্নমূল মানুষকে রাতযাপন করতে দেখা যায়।

চুরি-ছিনতাই : বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে চুরির ঘটনা নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। গণরুমের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র, বাইরে শুকাতে দেওয়া কাপড়, এমনকি হলের ভেতর রাখা মোটরসাইকেলের তেল চুরির মতো ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া দিনে-দুপুরে ল্যাপটপ, মানিব্যাগ, মোবাইলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

বহিরাগতদের উৎপাত : ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উৎপাত প্রকট আকার ধারণ করেছে। সন্ধ্যার সময় তাদের কলাভবনের বটতলা, টিএসসির সড়কদ্বীপ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সামনের মাঠ, ফুলার রোড, রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হলের সামনেসহ বিভিন্ন জায়গায় অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর