দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় এক শত কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ২৭ কিমি বন্যহাতির বিচরণ ক্ষেত্র। এ নিয়ে পরিবেশবাদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা নানা মত ও সুপারিশ দিলেও তা পুরোপরি আমলে নেয়নি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। যার পরিপ্রেক্ষিতে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালুর সাড়ে ১০ মাসের মাথায় পারাপারের সময় আহত হয়ে মারা যায় ১০ বছর বয়সি একটি বন্যহাতি। ফলে হাতির জন্য সেই ২৭ কিমি রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে হাতি চলাচলের পথ নিরাপদ করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তিনটি উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা যায়, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন নির্মিত রেলপথেই চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাইস্যাখালী (ফাঁসিয়াখালী) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক। এর মধ্যে চুনতি দিয়ে যায় ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য অঞ্চল দিয়ে ১০ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং দশমিক ৯ কিলোমিটার পথ যায় মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে। এ ২৭ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২১টি স্থানে আছে বন্যহাতির বিচরণ ক্ষেত্র, চলাচলের পথ ও বসতি। চট্টগ্রামে গত বছর ১০টি হাতি মারা যায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্ট (আইইউসিএন) প্রকাশিত বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় আছে এশিয়ান এলিফ্যান্ট। পরিবেশ সংগঠন গ্রিন ফিঙ্গারের কো ফাউন্ডার রিতু পারভীন বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা অনেক প্রতিবাদ করেছি। ১০ মাসের মধ্যেই শঙ্কা সত্য হলো। হাতির বিচরণ ক্ষেত্র হওয়ায় ৮টি জায়গায় আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণের জন্য চিহ্নিত করা হলেও হয়েছে মাত্র একটা। তাও ডিজাইন মতো হয়নি। হাতি যাওয়ার পথে দেওয়া হয়েছে বেত গাছের ব্যারিয়ার। যা কোনো মতেই পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া, রাতের বেলায় বনভূমির ভিতর দিয়ে যাওয়া রেল এত দ্রুত গতিতে কেন চলছিল- তাও প্রশ্ন। আমরা রেলের কাছে এ দুর্ঘটনার প্রতিকার দাবি করছি।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশ দিয়েই রেললাইনটি নির্মাণ করা যেত। পৃথিবীর কোনো দেশেই সংরক্ষিত বনের ভিতর দিয়ে রেলপথ নির্মাণের দৃষ্টান্ত নেই। ভারতে বনের ভিতর দিয়ে সামান্য পরিমাণ রেললাইন থাকলেও তাতে দুর্ঘটনায় হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা আছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া রেলপথটি অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। হাতির করিডরটা যেভাবে ডিজাইন করার কথা সেভাবে হয়নি। আন্ডারপাসটি তুলনামূলক ছোট। এটি নালা বা কালভার্টের মতো। এটি দিয়ে বড়জোড় একটা ছোট হাতি পার হতে পারবে। বড় হাতি চলাচল করতে পারবে না। তাছাড়া রাস্তাটাও অপরিষ্কার থাকার কথা শুনেছি। আর সেখানে যে গাছ লাগানোর কথা ছিল তা লাগানো হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাই আর কোনো দুর্ঘটনা না ঘটার মতো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। হাতি চলাচলে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য রেল চালকদের সতর্ক থাকা, দুই তিন স্টেশন আগে থেকেই সিগন্যালের ব্যবস্থা রাখা, রেসপন্স টিমের মাধ্যমে হাতি চলাচলের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা, আন্ডারপাস-ওভারপাসের যে সমস্যা দৃশ্যমান হচ্ছে তা দ্রুত সংস্কার করা এবং প্রয়োজনীয় গাছ লাগানো জরুরি।’
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সবুক্তগীন বলেন, ‘হাতি রক্ষায় ইতোমধ্যে তিনটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বনের কিছু জায়াগা খোলা ছিল সেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে, রেলে একটা সেন্সর বসানোর কথা ছিল, তা বসানো হবে এবং বনভূমি এলাকার দুই কিমি রেলপথে ধীর গতিতে চালানো হবে।’