শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

কিংবদন্তি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী

ড. এস. এম. ইলিয়াছ

কিংবদন্তি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাধীন প্রসিদ্ধ পশ্চিমগাঁও জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়কর প্রতিভা। নারী জাগরণ ও নারীশিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত। ঊনবিংশ শতক পূর্ববাংলার সমাজব্যবস্থা নানাভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। তারপরও সেই পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে একজন নারী হয়ে সবার অগ্রভাবে ছিলেন ফয়জুন্নেসা। তিনি ঊনবিংশ শতকের চতুর্থ দশকে পূর্ববাংলার এক নিভৃত পল্লীতে জন্ম নিয়ে তিনি সমাজের মানুষের কল্যাণে শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি একাধিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা চিরদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। রক্ষণশীল সমাজের অন্তঃপুরবাসিনী এই নারী নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তেমনি নিজেকে বিদ্বৎ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। শিক্ষা, সমাজ-কল্যাণ ও সেবায় তিনি যে উদাহরণ রেখে গেছেন তার তুলনা হয় না। কেবল সমাজসেবায় নয়, তিনি সাহিত্য সাধনায়ও অনন্য অবদান রেখেছিলেন তার উদাহরণ 'রূপজালাল' কাব্যগ্রন্থ। এই উপাখ্যানটি ১৮৭৬ সালে ঢাকা গিরিশ মুদ্রণযন্ত্রে শেখ মুন্সী মওলা প্রিন্টার্স কর্তৃক মুদ্রিত হয়। বইটির মূল্য ছিল দেড় টাকা। 'রূপজালাল' গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪১৭। এই গ্রন্থের অর্ধেকের বেশি পদ্যে লিখিত এবং অবশিষ্টাংশ গদ্যে লিখিত। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যের গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় তার 'রূপজালাল' গ্রন্থটি মধ্যযুগের কবি আলাওলের রচনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। সাহিত্য সাধনায় তার কৃতিত্ব তাকে পার্থিব জীবনে এনে দিয়েছে সুউচ্চ সম্মান, অন্যদিকে তেমনি অমরত্ব।

জানা যায়, নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পিতা আহমদ আলী চৌধুরীও ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ। তারই প্রথম কন্যা ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তার আরও তিন সন্তান ছিল ইউসুফ আলী চৌধুরী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, লতীফুন্নেসা। জমিদার বাড়ির আরাম-আয়েশের মাঝেও তার জমিদার পিতা শিশুকাল থেকে মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে গভীর মনোযোগ রেখেছিলেন। এমনকি পড়াশোনার দিকে মেয়ের অকৃত্রিম আগ্রহ লক্ষ্য করে তার জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি শুধু জনক-জনীর কাছেই প্রিয় ছিলেন না, মেধাবী ছাত্রী হিসেবে শিক্ষকের কাছেও ছিলেন গ্রহণযোগ্য। এ সম্পর্কে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী লিখেছেন_ 'আমি বাল্যাবস্থায় বয়স্যাদিগের সহিত ক্রীড়াকৌতুকে নিমগ্ন থাকিয়াও যথাসময়ে শিক্ষক সানি্নধানে অধ্যয়নাদি সম্পন্ন করিতাম।' একপর্যায়ে সমাজসেবাকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফয়জুন্নেসার পিতা আহমদ আলী চৌধুরী প্রয়াণের পর তার মা আফরান্নেছা বেশিদিন জমিদারি চালাতে পারেননি। কিছুকাল পরেই ফয়জুন্নেসার উচ্ছৃঙ্খল বড়ভাই নিজ হস্তে জমিদারি গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তার ফুফাতো ভাই জমিদার গাজী চৌধুরীর সঙ্গে ফয়জুন্নেসার বিয়ে হয়। ত্রিপুরা মহারাজের পরই চির গাজী চৌধুরীর অবস্থান। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই কন্যা আরশাদুন্নেছা ও বদরুন্নেসার জননী ছিলেন। তবে ফয়জুন্নেসার সংসার জীবন বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একসময় ফয়জুন্নেসা নিজেই জমিদারির হাল ধরেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি প্রজাদের কাছে প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন।

কুমিল্লার তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মি. ডগলাস ওই জেলার জন্য জনহিতকর সংস্কারমূলক একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে অর্থাভাবে বড় বিপদে পড়েন। তৎকালীন অর্থশালী বিত্তবান হিন্দু জমিদারদের কাছে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের পরিমাণ শুনে সবাই তাদের অপারগতা জানান। মি. ডগলাস কিন্তু কোনো মুসলমান জমিদারের কাছে এ আবদার জানাননি। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মুসলমানদের কাছ থেকে তিনি কোনো সাহায্যই পাবেন না। কারণ ইংরেজদের প্রতি তারা ছিলেন বিরূপ মনভাবাপন্ন। তাছাড়া পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন একজন নারী। এলাকার সংস্কার প্রকল্পে যখন কোনো হিন্দু পুরুষ জমিদার সাহায্যের হাত বাড়ালেন না, তখন একান্ত নিরুপায় হয়ে মি. ডগলাস জমিদার ফয়জুন্নেসার সাহায্য কামনা করেন। দূরদর্শী জমিদার ফয়জুন্নেসা মি. ডগলাসের সংস্কারমূলক পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সবিশেষে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জনকল্যাণ কতটুকু হবে তা ভেবে দেখার জন্য সময় নেন। এরপর তিনি প্রকল্পটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। একপর্যায়ে জনকল্যাণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় অর্থের সম্পূর্ণটাই একটা তোড়ায় বেঁধে একখানি চিঠিসহ মি. ডগলাসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চিঠিতে মি. ডগলাসকে লিখেছিলেন- 'আমি জনকল্যাণমূলক যেসব কাজ করতে চেয়েছিলাম তা আপনার হাত দিয়েই হোক, এই আশা করি। ... ফয়জুন্নেসা যে টাকা দেয় তা দান হিসেবেই দেয় কর্জ হিসেবে নয়।'

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী মি. ডগলাসকে কত টাকা পাঠিয়েছিলেন তা বর্তমানে সঠিকভাবে নিরুপণ করা সম্ভব নয়। কারণ, দানের পরিমাণের বিষয়টা ছিল গোপনীয়। সুদূর বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর একজন নারী জমিদারের সমাজসেবা ও উদার হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীও অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া তার সভাসদের পরামর্শক্রমে মি. ডগলাসকে নির্দেশ দেন_ জমিদার ফয়জুন্নেসাকে মহারানীর আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারিভাবে 'বেগম' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হোক। ডগলাস সাহেব ফয়জুন্নেসাকে এ ঘটনা জানালে তিনি সরাসরি মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান 'জমিদার হিসেবে নিজে জমিদারিতে 'বেগম' হিসেবে তিনি এমনিতেই সবার কাছে পরিচিত। সুতরাং নতুন করে 'বেগম' খেতাবের কোনো প্রয়োজন নেই।' তেজস্বী এই মহীয়সী জমিদারের কাছে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে মি. ডগলাস বড়ই বিপাকে পড়েন। ডগলাস নিরুপায় হয়ে তিনি সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুনরায় মহারানীকে জানান। মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখানের কথা শুনে রানী ফয়জুন্নেসার তেজস্বীতায় একাধারে অভিভূত এবং অন্যধারে গভীর সমস্যায় পড়েন। তারপর তাকে এই জমিদারকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে 'নওয়াব' খেতাব দেওয়া হয়।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন প্রজারঞ্জক ও জনকল্যাণকামী জমিদার। স্টেটের দেওয়ান লকিয়ত উল্লাহ ছিলেন তার দক্ষিণ হস্ত। এই প্রবীণ সুদক্ষ নায়েব ফয়জুন্নেসার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। ফয়জুন্নেসা সর্বদা আড়ালে থেকেই সব কাজকর্ম চালিয়ে যেতেন। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মাঝে মাঝে পালকি চেপে তিনি জমিদারি তদারকিতে বেরোতেন। বিভিন্ন মৌজায় গিয়ে প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে ব্যবস্থা নিতেন। সমাজের কল্যাণ সাধনই ছিল তার মহান ব্রত। নিরক্ষর, অসুস্থ মানুষের নিরাময়, সুখ-শান্তি কামনাই ছিল ফয়জুন্নেসার একান্ত কাম্য। এ জন্য তিনি একাধারে পরিখা খনন, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। লাকসামের পশ্চিমগাঁওতে ১৮৯৭ সালে তিনি হাসপাতাল নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি লাকসাম সরকারি দাতব্য চিকিৎসালয় নামে পরিচিত। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল'। এই হাসপাতালটি ফয়জুন্নেসার এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। কুমিল্লায় সুপেয় পানির অভাব ছিল সে জন্য তিনি পরিখা খনন ও পানির ট্রাং বসান। ফয়জুন্নেসা তার ওয়াক্ফ এস্টেটের অধীনে ১৪টি কাছারির প্রতিটি সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল এবং একটি করে পুকুর খনন করেন। স্বগ্রামে অর্থাৎ পশ্চিমগাঁওয়েও তিনি দুটি পুকুর খনন করেন। এই একটি দশ গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম দিকে শান বাঁধানো ঘাট আছে। এখানে মুসলি্লরা অজু করেন এবং গ্রামের জনসাধারণ প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা লাকসামের পশ্চিমগাঁও থেকে সংযোগ সড়ক, রাস্তা-ঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। পশ্চিমগাঁওয়ে 'ফয়েজিয়া মাদ্রাসা' নামে যে একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন তা এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা হজে যাওয়ার আগে নিজের বসতবাটিসহ সমস্ত সম্পদ জনকল্যাণে দান করেছিলেন। তিনি তার ওয়াক্ফ দলিলের প্রারম্ভেই বলেছেন- 'জগৎপিতা জগদ্বীশ্বরের কৃপায় আমি পার্থিব সর্বপ্রকার মান-সম্ভ্রম ও ঐশ্বর্য এবং ঐহিক সুখ-স্বচ্ছন্দতা বিপুল পরিমাণে ভোগ করিয়াছি। এই ক্ষণ আমার বৃদ্ধাবস্থা উপস্থিত বিধায় ইহকালের বৈষয়িক চিন্তাজাল হতে নিষ্কৃতি লাভ পারমার্থিক এ পারত্রিক উপকারজনক কার্যে মনোনিবেশ করাই সর্বেব্ববভাবে কর্তব্য।' পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কা নগরীতে গিয়েও সেখানে মানুষের জলকষ্ট নিবারণের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে 'নাহরে জুবাইদা' পুনঃখনন করেন। তিনি ১৯০৩ সালে প্রয়াত হন।

তার স্মৃতিকে অমর করে রাখতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে 'নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ফাউন্ডেশন। বতর্মানে এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এস এম মাহফুজুল হক। আজ নওয়াব ফয়জুন্নেসা বেঁচে নেই, আছে তার অমর কীর্তি। সমাজসংস্কারক এই মহান নারী তার কর্মের মাধ্যমে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।

 

সর্বশেষ খবর