পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের উত্থানটা বিস্ময়কর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেকে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছেন, নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আবার সেই ভাগ্যের অসাধারণ ম্যাজিকে অনেকে অর্জন করেছেন অসামান্য খ্যাতি। সময়কে পরাজিত করে হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরা কিংবা আলোচিত একজন। এদের মধ্যে অনেকে আবার একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করে পৌঁছেছেন পূর্ণতার শীর্ষে। এদেরই একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। মার্কিন ইতিহাস তো বটেই সমগ্র বিশ্বেই সর্বকালের সেরা শাসক কিংবা রাজনীতিবিদের তালিকায় অনায়াসে চলে আসে তার নাম। আব্রাহাম লিংকনের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও দারুণ শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় তাঁকে। লিংকনের শৈশব ছিল নিদারুণ কষ্টে ভরপুর। দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত ছিল তার পরিবার। বাবা মুচি ছিলেন। জুতা সেলাইয়ের কাজ করেও সংসার ঠিকমতো চালাতে পারতেন না তিনি। মাঝে মাঝে লিংকন নিজেও বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। এই পরিবেশেই আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠেন আব্রাহাম লিংকন।
তখনো কেউ ভাবতে পারেনি, এই ছেলে একদিন ইতিহাস হবে। ইতিহাস লিখবে। বিস্ময়কর সেই উত্থানের গল্প নিয়েই রকমারির এই আয়োজন।
‘লিংকন আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি একজন মুচির ছেলে’
আব্রাহাম লিংকন আমেরিকা তথা আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট লিংকন জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্র“য়ারি এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল। অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় প্রচেষ্টায় আমেরিকার অধিপতি হতে পেরেছিলেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর ছিল দরিদ্রতা আর সংগ্রামে ভরপুর। এরপরও তিনি তাঁর ভাগ্যকে পাল্টে ফেলতে পেরেছিলেন। লিংকনের বাবা মূলত জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এই পেশার আয় থেকেই সংসার চালাতেন তিনি। জুতা তৈরিতে তাঁর খ্যাতি ছিল। কিন্তু সামান্য আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো তাঁর। কখনো কখনো লিংকন নিজেও বাবার কাজে হাত লাগাতেন। বাবার কাছ থেকে জুতা সেলাইয়ের কাজ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন লিংকন। সেই ছোটবেলা থেকেই লিংকনকে সবাই মুচির ছেলে বলে খ্যাপাত। সবাই তাকে নিচু দৃষ্টিতে দেখত। বাবাকে নিয়ে আর দরিদ্রতাকে নিয়ে সবাই উপহাস করত। বন্ধুদের মধ্যে কেউই লিংকনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে চাইত না। তবে লিংকন ছিলেন অদম্য। ছোটবেলা থেকেই প্রচ- মানসিক দৃঢ়তা ছিল তার। কোনোমতেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। নিজের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে জীবনে এগিয়ে চলেন। এরপর আস্তে আস্তে উত্থান শুরু হয় নতুন এক লিংকনের। পরের গল্পটা সাফল্যে মোড়া। মুচির ছেলে ছিলেন বলে তাকে সব সময়ই অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। তখন তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে মাত্র পরিচিতি লাভ করছিলেন। একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলে এক ধনী ব্যক্তি তাঁকে থামিয়ে দেন। লোকটি তাঁকে বলেন, ‘লিংকন আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি একজন মুচির ছেলে। আপনার বাবা লোকের জুতা সেলাই করে। এমনকি তিনি আমাদের পরিবারের জন্য জুতা তৈরি করে দেন।’ এ নিয়ে তখন হাস্যরসের সূচনা হয়। কিন্তু লিংকন লজ্জা পেলেন না। বরং দৃঢ়ভাবে এর জবাব দেন। তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, আমার বাবা জুতা তৈরি করেন। তিনি খুবই দক্ষ একজন মুচি। কেউ কখনো আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে অভিযোগ করেননি। আপনিও মনে হয় আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে কোনো অভিযোগ রাখছেন না। যদি তার জুতা নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে তাহলে মানতেই হবে তিনি সেরা। আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করি এবং আমি নিজেও জুতা সেলাই করি।’ লিংকনের এই উত্তরে সবার হাস্যরস বন্ধ হয়ে যায়। উল্টো সবাই মুগ্ধ হয়। এভাবেই জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা বাধাগুলো ডিঙিয়ে সাফল্যের শীর্ষে উঠে আসেন লিংকন।
দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই
আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের একটি ছোট্ট গ্রামে কিংবদন্তি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের জন্ম। তাঁর বাবা টমাস লিংকন যে মুচি ছিলেন সেটা আগেই বলা হয়েছে। তিনি লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। অতি কষ্টে দীন-দরিদ্রের মতো তিনি সংসার চালাতেন। লিংকনের বয়স যখন চার, তখন পাল্টে যায় তার আবাসস্থল। বাবা টমাস লিংকন তখন পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের অরণ্যময় অঞ্চলে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করলেন। বলা বাহুল্য, সেই জায়গাটি তখনো মানুষের বসবাসের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বাড়ির চারদিকে জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় খুঁটি পোঁতা থাকত। তখন লিংকনের বাবার পেশাও পাল্টে যায়। কাঠের কাজ আর শিকার করেই নতুন করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। এই কঠিন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে করতে লিংকন হয়ে ওঠেন পরিশ্রমী ও সাহসী। লিংকনের বয়স যখন ছয়, তখন হঠাৎ করেই তার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এক গ্রাম্য ডাক্তার থাকতেন পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই সাত দিন পর মারা গেলেন লিংকনের মা। মা মারা যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা। লিংকনের বাবার পূর্ব পরিচিত এক মহিলার কিছু দিন আগে স্বামী মারা গিয়েছিল। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন টমাস। আব্রাহাম লিংকনের সৎ মা অবশ্য তাকে আদর করতেন। মূলত সৎ মায়ের আগ্রহে লিংকন শিখেছিলেন লিখতে, পড়তে, অঙ্ক করতে। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, আমার স্কুল জীবন সর্বসাকুল্যে এক বছরের বেশি নয়। ধীরে ধীরে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলেন লিংকন। দীর্ঘ দেহ, উচ্চতায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। লম্বা হাত, বলিষ্ঠ দেহ। দেহ অনুপাতে মাথাটি ছোট, যখন হাঁটতেন শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ত। তাঁর বয়স যখন উনিশ, তখন নিউ অর্লিয়েন্স বন্দরে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার ভার পড়ল তার ওপর। একটি বড় নৌকা বোঝাই পণ্য নিয়ে রওনা হলেন লিংকন। সেখানে এসেই লিংকন প্রথম দেখলেন নিগ্রো শিশু নারী পুরুষদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। দাসপ্রথার ব্যাপকতা দেখে তিনি এত খানি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, তার এক সঙ্গীকে বলেছিলেন যদি আমি কোনো দিন সুযোগ পাই এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানব। নিউ অর্লিয়েন্সে ভালোই ব্যবসা করলেন লিংকন। তার কাজে খুশি হয়ে পণ্যের মালিক তাকে নিউ সালেমের গুদামের ম্যানেজার করে দিলেন। এখানে কাজের তেমন চাপ ছিল না। অবসরের সময়টুকু তিনি নানা বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন।
ম্যানেজার-পিয়নের চাকরি
গুদামের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটে লিংকনের। একটি প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। এরপর নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। মধুর ব্যক্তিত্ব, সহযোগিতামূলক আচরণ, স্পষ্টবাদিতার কারণে অল্প দিনেই তিনি নিউ সালেমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি পরিচিত হলেন স্থানীয় একটি সরাইখানার মালিক জেমস রুটলেজর সঙ্গে। তিনি লিংকনকে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। এর মধ্যেই ইলিনয় রাজ্যের প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হলো। কয়েকজনের উৎসাহে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন লিংকন। কিন্তু রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি নির্বাচনে পরাজিত হলেন। বেকার হয়ে পড়লেন। এরপর বাধ্য হয়ে নিউ সালেমে পিয়নের চাকরি নিলেন। ১৮৩৪ সালে আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। এবার তিনি জয়লাভ করলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে যেতে হলো ইলিনয়ে। পরিষদের কাজকর্মের অবসরে অখ- সময়, তখনই তিনি আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
ইতিহাস কাঁপানো ভাষণ
১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের যুদ্ধের প্রায় চার মাস পর ১৯ নভেম্বর পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে এক স্মরণসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন লিংকন। বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফটোসাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের বক্তৃতা শেষ করেন লিংকন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, Government of the People , by the People, for the People. অর্থাৎ, ‘গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’। যা গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে আজও বিবেচিত। এই বক্তৃতার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপস্থিত জনতা। এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে যান তারা। অনেকের ক্যামেরা সচল করার আগেই শেষ হয়ে যায় তিন মিনিটের বক্তৃতা। প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানের মূলবক্তা ছিলেন পেশাদার এবং বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট, যিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট দুঃখ করে বলেন, ‘আমি যদি আমার দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় লিংকনের তিন মিনিটের বক্তৃতার মূল কথার কাছাকাছি কিছু বলতে পারতাম, তাহলে আমার জীবন ধন্য হতো।’ ১৮৬৩ সালের ১ থেকে ৩ জুলাই গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু হলে এক ধর্মযাজক কথা প্রসঙ্গে লিংকনকে বলেছিলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আসুন, আমরা বিশ্বাস রাখি এবং প্রার্থনা করি যে, এই দুঃসময়ে ঈশ্বর আমাদের পক্ষে থাকবেন।’ উত্তরে লিংকন বললেন, ‘ঈশ্বর নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। কারণ আমি জানি যে, ঈশ্বর সব সময় ন্যায় ও সত্যের পক্ষেই থাকেন। এর চেয়ে বরং আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, এই জাতি যেন সব সময় ঈশ্বরের পক্ষে থাকতে পারে।’
দাস প্রথা বন্ধের কারিগর
দাস প্রথা সমর্থনের ব্যাপারে ইতিপূর্বে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতবিরোধ ছিল। দক্ষিণের রাজ্যগুলো স্থির করল তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সাউথ ক্যারোলিনার নেতৃত্বে আলাবামা, ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, লুজিয়ানা, টেক্সাস ও জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করে এক পৃথক যুক্তরাষ্ট্র স্থাপন করল। এই নব ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেফারসন ডেভিসের নাম ঘোষণা করা হলো। লিংকন চেয়েছিলেন দাসপ্রথা নির্মূল হোক, কিন্তু দেশ বিভক্ত হলে কখনই তার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। তাই নিজের সীমিত শক্তিকে সম্বল করেই দক্ষিণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। শুরু হলো আমেরিকার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি লিংকন চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটল। এই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আব্রাহাম লিংকন আদেশ দিচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে, উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোতে ক্রীতদাসরূপে যারা বন্দি রয়েছেন তারা এখন থেকে স্বাধীন মুক্ত।’ যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণের সেনাপতি লির অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য উত্তরাঞ্চলের সেনাবাহিনী যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে পরাজিত হতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যুদ্ধ শেষ হলো। লি আত্মসমর্পণ করলেন। জিতে গেলেন লিংকন। ওয়াশিংটনে ফিরে এলেন তিনি। শত শত মানুষের অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে গেলেন তিনি।
তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য
দাস প্রথা বিলুপ্ত হলো। যুদ্ধজয়ী লিংকন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। ওয়াশিংটনে তখন জনগণের ভিড় কমতেই একে একে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা এলেন। এদিকে রাতের বেলায় থিয়েটারে যাওয়ার কথা। অনেকটা মেরির অনুরোধেই রাজি হন লিংকন। থিয়েটার হলে পৌঁছাতেই সব দর্শক তাকে অভিনন্দন জানাল। নিজের আসনে গিয়ে বসলেন লিংকন আর মেরি। দুই ঘণ্টা কেটে গেছে, বক্সের দরজার সামনে যে প্রহরী ছিল তার কাছে একজন লোক এসে বলল প্রেসিডেন্টকে একটা সংবাদ দিতে হবে। রক্ষী ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিতেই আততায়ী ভিতরে ঢুকেই লিংকনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। চেয়ারের ওপর লুটিয়ে পড়লেন লিংকন। লিংকনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো থিয়েটার হলের সামনের একটা বাড়িতে। আঘাতের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ দেহের প্রাণসত্তার দ্বন্দ্ব চলল নয় ঘণ্টা ধরে। সকাল ৭টায় অজ্ঞান অবস্থায় লিংকন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুর সময় লিংকনের বয়স হয়েছিল ছাপ্পান্ন বছর। প্রেসিডেন্ট লিংকন খুন হন আততায়ী উইলকিস বুথের গুলিতে। সে সময় আমেরিকার দক্ষিণের কিছু রাজ্য স্বাধীন হতে চাইছিল, কিন্তু লিংকন আমেরিকার একত্রীকরণে আগ্রহী ছিলেন। অচিরেই বুথকে খুঁজে বের করা হয়। এরপর বুথ আত্মহত্যা করে। সমস্যা হলো, ধরা পড়ার সময় বুথ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্যারালাইজড ছিল, যে কিনা নিজের হাত পর্যন্ত নাড়াতে সক্ষম ছিল না। তাহলে বুথ কীভাবে মারা গেল? ফলে লিংকনের মৃত্যুরহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
যেভাবে সাফল্যের শীর্ষে
রাজনৈতিক অভিপ্রায় জেগে ওঠার পর লিংকন দেখেন, তিনি তাঁর কথার শক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষদের কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি তাদের প্রতি কড়া সমালোচনা ছুড়ে দিলেন। ১৮৪০ সালে এক রাজনৈতিক সভায় তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ লেস থমাসের নকল করে তাকে মজা করেছিলেন, যা দর্শক তুমুলভাবে করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়। অল্প দিনের মধ্যেই ইলিনয়ের রাজনৈতিক জগতে নিজেকে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশেষে ১৮৪৭ সালে ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ হোয়াইট হাউসের অদূরেই গড়ে উঠেছে নিগ্রো দাসদের খোঁয়াড়। বিভিন্ন জায়গা এবং দেশ থেকে নিগ্রো দাসদের এখানে নিয়ে আসা হতো তারপর দক্ষিণের বাজারে চালান করে দেওয়া হতো। দীর্ঘদিন ধরে লিংকন ছিলেন এই দাস প্রথার বিরোধী। লিংকন পার্লামেন্টের সভায় কলম্বিয়া রাজ্যে দাস ব্যবসা বন্ধ করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করলেন। সম্মিলিত বিরোধিতায় সেই বিল অগ্রাহ্য হলো। ব্যর্থ হয়ে লিংকন ফিরে এলেন স্প্রিং ফিল্ডে। আবার আইন ব্যবসা শুরু করলেন। রাজনীতিতে আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু দাস প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়ে উঠলেন ঠিকই। ১৮৫৪ সালে নতুন রিপাবলিকান পার্টি গঠিত হলো। এই দলের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্রাহাম লিংকন। তিনি এই দলের রাজনৈতিক আদর্শের কথা এত সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলেন, সব দেশ তার বাগ্মিতায় মুগ্ধ হলো। এর অল্প দিনের মধ্যে এক ঐতিহাসিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন লিংকন। দক্ষিণের রাজ্যগুলো দাস প্রথার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলতে আরম্ভ করেছিল। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ডগলাস প্রবলভাবে এই দাস প্রথা সমর্থন করতে আরম্ভ করলেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য জোরালো দাবি পেশ করছিল লিংকন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, একটি রাষ্ট্র কখনো দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে না। আমেরিকা অবশ্যই এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এই সময় রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য লিংকনের নাম ঘোষণা করা হলো। রিপাবলিকান দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন লিংকন আর তার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক দলের হয়ে প্রার্থী হলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্ব ডগলাস। ডগলাসকে হারিয়ে লিংকন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ১৮৬১ সালের ফেব্র“য়ারিতে লিংকন স্প্রিংফিল্ড ছেড়ে ওয়াশিংটনের দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে স্ত্রী মেরি। তাঁর এত দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই জয় আমৃত্যু লিংকনের সব মানসিক শান্তিকে কেড়ে নিয়েছিল।
ছিল না আনুষ্ঠানিক শিক্ষা
লিংকনের তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। স্কুলে যাওয়াটাও নিয়মিত হয়নি। কিন্তু সশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন তিনি। বাইবেল বা শেকসপিয়র থেকে অবলীলায় দরকারি উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পারতেন। ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। জন্মস্থান কেন্টাকির ছোট্ট লগ হাউসের কেবিন থেকে লিংকনের হোয়াইট হাউস যাত্রাকে দেখা হয় আমেরিকান স্বপ্নের নকশা হিসেবে। ১৮৩০ এর পরে লিংকন সিদ্ধান্ত নেন আইনজীবী হওয়ার। নিজে নিজেই আইনের বই পড়া শুরু করেন। নিজের এই শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে লিংকন বলেছিলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে পড়াশোনা করি না।’ ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজের অনুমতি পান। আইনজীবী হওয়ার আগেই অবশ্য লিংকনের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল উহিগ পার্টিতে। এরপর তিনি রিপাবলিকান পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
আইনজীবী ও ব্যক্তিজীবন
১৮৩৬ সালে লিংকন কৃতিত্বের সঙ্গে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওকালতি আরম্ভ করলেন। বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ থাকা সত্ত্বেও অল্প দিনেই লিংকন আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেন। একটি বড় কারণ ছিল তার সততা, নির্লোভ মন। তিনি কখনো কোনো অন্যায়কে মেনে নিতেন না। মিথ্যা মোকদ্দমায় তাঁকে নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি সেটা ফিরিয়ে দিতেন। এরপরও আইনজীবী হওয়ার চেয়ে রাজনীতির প্রতিই লিংকন ক্রমে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। ১৮৩৮-১৮৪০ সালে পরপর দুবার তিনি ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। এ সময় ব্যবস্থাপক সভায় স্টিফেন ডগলাস নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় লিংকনের। এই ডগলাস পরবর্তী জীবনে লিংকনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত এক নারীকে কেন্দ্র করে। সেই সুন্দরীর নাম মেরি টড। এক রাতে ডগলাস আর লিংকন গিয়েছেন নাচের আসরে। সেই আসরে এসেছে মেরি। ডগলাস ছিলেন সুদর্শন। অপর দিকে লিংকন ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। চেহারায় রুক্ষতা আর আদিম ভাব। কিন্তু ডগলাস নন, বরং লিংকনের সেই রুক্ষতার প্রতিই আকৃষ্ট হলেন মেরি। কিছু দিন পর মেরিকে বিবাহের প্রস্তাব করলেন লিংকন। কিন্তু মেরি ছিলেন উচ্চাকাক্সক্ষী, তা ছাড়া সন্দেহ, ঈর্ষাবোধও ছিল প্রবল। বিয়েতে একমত হতে পারছিলেন না তিনি। এর মধ্যেই রাজি হলেন মেরি। ১৮৪২ সালের ৪ নভেম্বর তাদের বিয়ে হলো। পরবর্তীতে স্ত্রীর আগ্রহে রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন লিংকন।