পর্ব-৭
শুনুন মনিরুল সাহেব, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। চলুন দেখি!
আমি রীতিমতো বিস্মিত হই,
আপনি আমার নামও জানেন? অথচ...
অথচ আমাকে আপনি মনে করতেই পারছেন না, তাই তো!
পায়ে পায়ে আমরা হাঁটতে শুরু করেছি। হাঁটছি। ভাবছি, ভদ্রলোকের কথাটা সত্যি, তবু স্বীকার করতে সংকোচ বোধ হচ্ছে। আমি গাঁইগুই করে বলি,
হ্যাঁ, মানে মনে করার চেষ্টা করছি-কোথায় যেন আমাদের পরিচয় হয়েছিল!
ভদ্রলোক অবলীলায় হাত বাড়িয়ে দেন,
আসুন আবারও হয়ে যাক পরিচয়। আমি ওসমান গনি, ম্যান অব খুলনা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় পাস করেছি। পূর্ণ বেকার। ভাই-ভাবির বাসায় থাকি খাই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, আর কিছু?
না না, ঠিক আছে। পরিচয়টা কোথায় হলো যেন...
আরে ভাই, গত মাসে আমরা পাশাপাশি সিটে বসে যুব অধিদপ্তরের পরীক্ষা দিলাম না।
মুছে যাওয়া ছবিটা ঝট করে ভেসে আসে চোখে। আমার একটা পাটীগণিতের উত্তর মিলছে না দেখে নিজের খাতার পাতা উল্টিয়ে ধরেন এবং আমাকেই তাড়া লাগান- জলদি মিলিয়ে নিন তো ভাই।
আমি সে দিনও অবাক হয়েছিলাম, কমপিটেটিভ পরীক্ষায় এভাবে কেউ কাউকে হেল্প করে নাকি! করেও হয়তো বা কেউ কেউ। যেমন এই মানুষটির গায়ে পড়া স্বভাবটা সহজেই চোখে পড়ে, কিন্তু কারও গায়ে বাধে না। তার আন্তরিকতাটুকুই বড় হয়ে ওঠে। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে এক চায়ের স্টল ঠিকই আবিষ্কার করে বসেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ওসমান গনি নিজে থেকেই গল্প ফাটান আকাশ-পাতাল-‘আমিও ফকির হলাম, দেশেও আকাল হলো’ প্রবাদ শোনেননি? আমার হয়েছে তাই। একটু দম নিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে আবারও শুরু করেন-মামা বলতেন, মাস্টার্স পরীক্ষাটা শেষ করেই চলে আয়, তারপর যা করার আমি করছি। কিন্তু এখন! এখন কী হচ্ছে! আমার পরীক্ষা শেষ হলো ঠিকই, কিন্তু আমার মামাই তো আর মামাবাড়িতে নাই। তাহলে উপায়! নিজের দুর্ভাগ্য নিয়েও বেশ রসিয়ে কথা বলেন ভদ্রলোক, শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু তাঁর মামাটা কে, জানতে ইচ্ছে করে-মামাটা?
মামা?
হা হা করে খানিক হেসে নেন। তারপর বলেন-আমাদের মামার কি মামাত্ব আছে ভাই! এই সরকার তো সবার বিচি বের করে দিচ্ছে। কোন মামার কথা বলব!
এই যে এখনই আপনার যে মামার কথা বললেন!
মামার বন্ধু, মামাই তো হয়-নাকি?
হ্যাঁ, তা হয়। সেই বন্ধুটা কে?
নাম দিয়ে কী হবে! পাওয়ারফুল মিনিস্টার ছিলেন। ম্যাডামেরও নেকনজর ছিল তাঁর প্রতি। বাপরে বাপ! কী যে দাপট তাঁর!
আমি আর কথা না বলে ওসমান গনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বড় অদ্ভুুত মানুষ। একা একাই কথা বলেন। কথা না বললে যেন তার দম আটকে যাবে। কথার ফাঁকে ফাঁকে সিগারেটে দম কষে ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে শূন্যে ছোড়েন। মুখ থেকে ধোঁয়ার রিংগুলো বেরিয়ে ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু তাঁর কথার রেশ অত সহজে মিলায় না। নিজে মুখে মামাকাহিনি বয়ান করেন,
বাবাজি গিলেছিলেন গলা পর্যন্ত, পেট ফুলে ঢোল, এখন ডুবেছেনও গলা পর্যন্ত। না না গলা পর্যন্ত হবে কেন, এখন তাঁর বাঁশ যাচ্ছে মাথার চাঁদি পর্যন্ত।
এতক্ষণে আমি শুধাই,
আপনার মামার কথা বলছেন, নাকি মামার বন্ধুর কথা বলছেন?
বাঁশ যাচ্ছে দুজনেরই পোঁদে। কেউ তো কম খায়নি। একজন মন্ত্রী হয়ে খেয়েছে, অন্যজন মন্ত্রী না হয়েও খেয়েছে জন্মের খাওয়া।
আমাদের চা খাওয়া শেষ। ওসমান গনির গল্প শুনে মজা পাচ্ছি বলে মন দিয়ে শুনছি। এমন সময় আমার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যায় একটা সাদা রঙের গাড়ি। বেরিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু গজ দশেক এগিয়ে যাওয়ার পর ব্রেক কষে, তারপর পিছিয়ে এসে দাঁড়ায় আমার পাশে। বাঁ সাইডের গ্লাস নামিয়ে গলা বাড়িয়ে ধবধবে ফর্সা এক ভদ্রলোক বলেন- এই মনিরুল যে! এখানে কী হচ্ছে?
আমি চোখ গোল গোল করে আগন্তুক ভদ্রলোকের চেহারার দিকে তাকাই মাথার সামনের দিকে চুল পাতলা, ক্লিন শেভ, চোখে কড়া রঙের সানগ্লাস। আমার প্রতিক্রিয়া বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক দরজা ঠেলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন,
আমাকের চিনতে পারছ না মনিরুল!
সানগ্লাস খোলার পর খুব চিনতে পারছি মি. দেবাশীষ রায়, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, আমাদের দেবুদা।
রাইট। তা চিনতে এতক্ষণ লাগল!
কতদিন দেখা নেই বলুন তো! তা ছাড়া আগের চেয়ে আপনার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, উজ্জ্বল ফর্সা হয়েছেন, আর ওই সানগ্লাস...
দেখা নেই মানে তুমি তো দেখা করতেই চাও না, দেখা হবে কী করে?
আমি ভয়ানক চমকে উঠি, বলে কী লোকটা? তরু কি ঘরের কথা বাইরে এভাবে চাউর করে দিয়েছে? আমি যে যেতে চাই না-এ কথা তো কখনো বলিনি তরুকে! সেই বৃষ্টিবিঘিœত (বৃষ্টি মুখরিতও বটে) সন্ধ্যায় নাটক দেখতে যাওয়া হয়নি বটে, তারপর আরও দু-তিনবার তরু বলেছে দেবুদাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা, আবার নাটক দেখার কথাও হয়েছে; কিন্তু আমি নানা কৌশলে এড়িয়ে গেছি, তাই বলে যাব না বলিনি তো কখনো! মনে মনে তরু তাহলে এমনটাই ধরে নিয়েছে এবং সেটাই আবার লাগিয়েছে দেবাশীষ রায়ের কাছে! তলে তলে ওদের তাহলে এত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ! আমার নীরবতার কী যে অর্থ করেন উনি, হঠাৎ কাঁধে থাবা দিয়ে বলেন,
ওঠ, গাড়িতে ওঠ।
আমি ভয়ানক বিব্রতবোধ করি। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে শুধাই,
কোথায় যাবেন?
আহা ওঠ না। মজার জায়গায় নিয়ে যাব। ওঠ।
দেবুদা নিজ হাতে গাড়ির দরজা মেলে ধরেন। আমি অসহায় ভঙ্গিতে একবার ওসমান গনির দিকে তাকাতেই দেবুদা জিজ্ঞেস করেন,
সঙ্গে কেউ আছে নাকি?
আমি জবাব দেওয়ার আগে ওসমান গনি অনুমতি দেন,
যান না, যান। তাড়াতাড়ি ঘুরে আসবেন।
দেবাশীষ রায় একনজরে ওসমান গনিকে জরিপ করে নেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করেন,
এখানে তোমাদের কী কাজ বল তো!
আমি আবারও এক দুর্বোধ্য সংকটে পড়ি। দেবুদাকে আমি কেমন করে বুঝাই, এখানে আমাদের কী কাজ। ঠিক এই মোড়টাতে এসেছিলাম চা খেতে, সে পাট চুকেছে। ঠিক চা খাওয়াই কি ছিল মুখ্য ব্যাপার? ইন্টারভিউঅলারা সময় পিছিয়ে দিল দু’ঘণ্টা, আমরা এসেছিলাম সময় কাটাতে। কিন্তু এসবের কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না। অবশ্য আমার বেকারত্বের খবর দেবাশীষ রায়ের অজানা নয়, সে আমি জানি। এ তথ্য আমি যে তার কাছে লুকাতে চাই বা লুকানোর কোনো দরকার আছে তেমনও নয়। তবু এক্ষুনি আমাকে ছুটতে হবে একটা ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে, এখন এই দিলকুশায় এ জন্যই এসেছি। দেবুদার কাছে সোজাসুজি এসব বলতে কী যেন এক ব্যাখ্যাহীন বাধা অনুভব করি। হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে আমি দেবুদার হাতের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সজোরে নাড়া দিয়ে বলি,
আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন যান তো দেবুদা! আমি আপনার সঙ্গে পরে দেখা করব এক সময়।
দেবাশীষ রায় নাছোড়বান্দা হয়ে লাগেন,
আমি যেখানে যাচ্ছি, তোমাকে তো সেখানেই নিয়ে যেতে চাচ্ছি। চলো দেখি!
আজ থাক না দেবুদা!
তাহলে তোমাকে খুলেই বলি। আমি যাচ্ছি আমাদের লোকাল অফিসে; এই পর্যন্ত বলার পর গলাটা একটু নামিয়ে যোগ করেন- মানে তোমার তরুর অফিসে। হা হা করে হেসে ওঠেন দেবাশীষ রায়। তারপর দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন- কি, এবার যাবে তো?
না দেবুদা, আপনি যান। আমার একটু অসুবিধা আছে।
দেবাশীষ রায় এতক্ষণে যেন-বা বাস্তবতার মাটিতে পা রাখেন,
তাহলে সত্যিই তুমি যাবে না আমার সঙ্গে?
প্লিজ আপনি ভুল বুঝবেন না, আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
বেশ। থাক তাহলে!
দেবুদার ফর্সা ধবধবে চেহারায় অসন্তুষ্টি ও বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। আর মোটেই দেরি না করে তিনি গাড়িতে উঠে চলে যান। আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কয়েক মুহূর্ত। নিজের মনে প্রশ্ন জাগে-এটা কি আমি ঠিক করলাম! দেবাশীষ রায় তো এক্ষুনি গিয়ে তরুর কাছে জানতে পারবে দিলকুশায় আমি কেন দাঁড়িয়ে আছি, এমনকি তরুদের অফিসে আমি যে যাই না, এটাও কি ঢাকা থাকবে তার কাছে! প্রিয় দেবুদাকে কাছে পেয়ে আরও কত কথা যে গড়গড়িয়ে বলবে তরু, তার কি ঠিক আছে!
ওসমান গনি হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দেখিয়ে ইঙ্গিতে জানতে চায়- চলবে?
ঘাড় নেড়ে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিই, না, চলবে না।
আমি সিগারেট না ধরলেও ওসমান গনি এবার সোজা আমাকে চেপে ধরে, ওই লোকটা কে বটে মনিরুল ভাই?
দেবাশীষ রায়!
বুঝলাম, মালাউনকা বাচ্চা হ্যায়। তো আপনার সঙ্গে সম্পর্ক কীসের?
না, সম্পর্ক তেমন কিছুই না। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একই সময়ে লেখাপড়া করেছি, এই আর কী।
বেশ হোমড়া চোমড়া মনে হলো।
শুনেছি একটা কোম্পানির এক্সিকিউটিভ।
আপনাকে খুব টানাটানি করছিল যে!
প্লিজ, আপনি একটু থামবেন!
স্যরি! লোকটাকে আপনার পছন্দ নয় মনে হলো তো, তাই।
[চলবে]