শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দর্শন এবং বিজ্ঞানের মহানায়ক ওমর খৈয়াম

সাইফ ইমন

দর্শন এবং বিজ্ঞানের মহানায়ক ওমর খৈয়াম

পারস্যের খোরাসানের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত ইমাম মোয়াফেফক নিশাপুরীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন ওমর খৈয়াম। দিনের বেলায় জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়ানো, সন্ধ্যায় মালিক শাহের দরবারে পরামর্শ প্রদান এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি জালালি বর্ষপঞ্জি সংশোধন- সবটাতেই তাঁর নিষ্ঠার কোনো কমতি ছিল না। জীবদ্দশায় ওমরের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসেবে। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। ওমরের আরও একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা,  যা পরবর্তী সময়ে অইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুস্তক মাকালাত ফি আল জার্ব আল মুকাবিলা প্রকাশিত হয়। ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ হিসেবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।  এই মনীষীকে নিয়ে আজকের রকমারি-

 

ফার্সি তথা বিশ্বসাহিত্যের মহান কবি

মুসলিমদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন ওমর খৈয়াম। একই সঙ্গে একজন দার্শনিক, কবি, গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। রসকষহীন গণিত নিয়ে তিনি  কাজ করেছেন। আবার তিনিই লিখেছেন মধুর সব কবিতা।

মুসলিম সভ্যতার ক্রমবিকাশে মুসলিম মনীষীদের অবদান অবিস্মরণীয়। যুগ যুগ ধরে গবেষণা ও সৃষ্টিশীল কাজে তাঁদের একাগ্রতা প্রমাণিত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা সভ্যতার বিকাশকে করেছে আরও গতিশীল। রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস- সর্বত্র ছিল তাদের অগ্রণী পদচারণা। বহু মুসলিম বিজ্ঞানী দিগন্ত উন্মোচনকারী আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। সেসব আবিষ্কার ও গবেষণার আধুনিকীকরণ ঘটেছে, তার সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। দুনিয়া কাঁপানো মুসলিমদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন ওমর খৈয়াম। একই সঙ্গে একজন দার্শনিক, কবি, গণিতজ্ঞ এবং  জ্যোতির্বিদ। রসকষহীন গণিত নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। আবার তিনিই লিখেছেন মধুর সব কবিতা। কখনো বর্ষপঞ্জিকা নিয়েও কাজ করেছেন। আবার কখনো চতুষ্পদী কবিতার অমর সংকলন ‘রুবাইয়াত’ রচনা করেছেন তিনিই। আধুনিক বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে তাঁর হাতে, কাজ করেছেন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়েও। ভূগোল, বলবিদ্যা, খনিজবিজ্ঞান, আইন, এমনকি সংগীতও বাদ যায়নি তার জ্ঞানপিপাসার তালিকা থেকে। জীবনের শেষ দিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক; শিক্ষাদান করেছেন ইবনে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। তিনি সত্যিই অসাধারণ, অতুলনীয়, অনুপম; তিনি ওমর খৈয়াম। ‘রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ বইটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। এর লেখক কাজী নজরুল ইসলাম। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা কবিতা অবলম্বনে এই অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন কাজী নজরুল। সৈয়দ মুজতবা আলী এর ভূমিকা লেখেন। জীবনবাদী ওমর খৈয়াম নজরুলকে খুব আকর্ষিত করেছিলেন। এ অনুবাদে অত্যন্ত চমৎকার ভাষাভঙ্গি ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অনুবাদকারের চেয়ে নজরুলের অনুবাদ অনুভূতির পরশে, যথাযথ শব্দের পারিপাট্যে উজ্জ্বল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রখ্যাত আল কাতানজানি খৈয়ামের বিজ্ঞান সাধনার ফিরিস্তি দিয়ে একটি কিতাব রচনা করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ওমর খৈয়ামের মতো একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী শুধু পারস্যে নয়, সারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন কি না সন্দেহ আছে। তিনি বিশ্বের বিস্ময়। কালের নিরিখে সেকালের বিজ্ঞান গবেষণার মূল্যায়ন ছিল না। তা না হলে ওমর খৈয়ামই তাঁর মান-মন্দির থেকে প্রথম প্রমাণ করেছেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে এমন নিখুঁত হিসাব আর কেউ এর আগে দেয়নি। ওমর খৈয়াম চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন। এসব কবিতা ‘রুবাইয়াত’ নামে খ্যাত। বিশ্বের মানুষ তাঁকে কবি হিসেবে চেনে ও জানে। তাঁর কবিতাগুলো তাঁর ইন্তেকালের ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডওয়ার্ড ফিজারেল্ড ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এরপরই ওমর খৈয়ামের মনের খেয়ালের রচনাগুলো প্রকৃতির খেয়ালে বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই সঙ্গে ওমর খৈয়ামকে অন্যতম সেরা কবির আসনে সমাসীন করে। ওমর খৈয়াম ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা বিজ্ঞানী। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান, বীজগণিত ও জ্যামিতি। দর্শন শাস্ত্রে তিনি ছিলেন মস্তবড় পণ্ডিত। আর ছিলেন পুরোপুরি অহংকারবিবর্জিত একজন। তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য তাঁর জীবনের মূল্যবান সময় অতিবাহিত করেন। জ্ঞানচর্চার প্রতি তিনি এতই মনোযোগী ছিলেন যে, কোনো বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করতেন।

সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের অনুরোধে তিনি রাজকীয় মান-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার মহাপরিচালক নিযুক্ত হন তিনি নিজেই।  এ সময় সুলতান তাঁকে একটি সঠিক সৌর বর্ষপঞ্জি তৈরির অনুরোধ জানান। ওমর খৈয়াম মাত্র কয়েকজন সহকর্মী বিজ্ঞানী নিয়ে অল্প দিনেই সাফল্যের সঙ্গে ও নিখুঁতভাবে একটি সৌর বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। এর নাম দেন আততারিখ আল জালালি অব্দ।

 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেছিলেন হিজরি পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সেলজুক যুগে। তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখনকার ইরানের পুরনো নাম ছিল পারস্য আর তার রাজধানী ছিল খোরাসান। ইরানের নিশাপুর শহরে ওমরের জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন তাঁবুর কারিগর ও মৃৎশিল্পী। ছোটবেলায় তিনি বালি শহরে সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত শেখ মুহাম্মদ মানসুরীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই ওমর খৈয়াম খুবই মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। পড়াশোনার প্রতি গভীর মনোযোগ তাঁর অসামান্য সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। যে কোনো দর্শনগ্রন্থ বা বিজ্ঞানের কঠিন ও জটিল গ্রন্থগুলো কয়েকবার পড়লেই তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। তাঁর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না।  জ্ঞানচর্চার জন্য আমির আবু তাহির তাঁকে কিছু আর্থিক সহায়তা করেন এবং রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলে তাঁর জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে দেন।

 

নজরুলের ওমর প্রেম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম ওমর খৈয়ামকে অনেকটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তবে কতটা ভিতর থেকে জেনেছেন সেটির প্রমাণ ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ এর ভূমিকা। কিন্তু ফার্সি ভাষার সঙ্গে কবি নজরুল অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন মস্তবড় ফার্সিবেত্তা। শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুলের দ্বিতীয় ভাষা ছিল ফার্সি। ফলে কবি নজরুল মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছেন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতগুলোও। নজরুল ওমর খৈয়াম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শরাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনি, তাঁর জীবনও ছিল তেমন। তিনি মদ্যপ- লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ওভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।’

 

জীবনের অজানা দিক

ওমর খৈয়ামের জীবনের অনেক দিকই আমাদের অজানা। তাঁর অনেক কাজও দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। তাঁর দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর বিয়ে নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তবে ধারণা করা হয়, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর একটি সন্তানও ছিল। তবে এই ধারণার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আরেক সূত্র দাবি করে, তিনি কখনো বিয়ে করেননি। ১১৩১ সালের ৪ ডিসেম্বর ওমর খৈয়াম তাঁর জন্মস্থান নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর আগে এমন একটি বাগানে তাঁর লাশ সমাহিত করার কথা বলে গিয়েছিলেন, যেখানে বছরে দুইবার ফুল ফোটে। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। দীর্ঘকাল তাঁর কবরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৯৬৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে তাঁর কবর খুঁজে পাওয়া যায় এবং তা নিশাপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সে স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। একটি সূত্র দাবি করে, মৃত্যুর আগে ওমর খৈয়াম তাঁর ছাত্রদের শেষবারের মতো বিশেষ উপদেশদানের জন্য আহ্বান জানান। এরপর তিনি ভালোভাবে ওজু করেন এবং এশার নামাজ আদায় করেন। সেজদারত অবস্থায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন।

 

গণিত চর্চা ও জোতির্বিদ্যা

বীজগণিত দিয়েই নিজের গবেষণা জীবন শুরু করেছিলেন ওমর খৈয়াম। তিনিই অনুধাবন করেছিলেন, প্রচলিত গ্রিক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান সম্ভব নয়। তাই নতুন পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ওমর এবং খুব তাড়াতাড়ি সাফল্য এসে ধরাও দেয় তাঁর কাছে। ১০৭০ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি সমাধান করে ফেলেন ত্রিঘাত সমীকরণের। ওই বছরই ওমর খৈয়াম তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কাজ, ‘ডেমোনস্ট্রেশন অব প্রবলেমস অব অ্যালজেবরা অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বৃত্ত, প্যারাবোলার মতো কণিক ব্যবহার করাসহ ত্রিঘাত সমীকরণের একাধিক সমাধান পদ্ধতির উল্লেখ করেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত রচনা ‘ট্রিটিজ অন ডেমোনস্ট্রেশন অব প্রবলেমস অব অ্যালজেবরা অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’। এখানে তিনি সম্পূর্ণ বীজগাণিতিক উপায়ে ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধান করেন। আর এই কাজই তাঁর সময়ের প্রথম সারির গণিতবিদ হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। এনে দেয় খ্যাতি। খৈয়াম যে পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন তা ছিল সুলতান মালিক শাহ কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত। সুলতান মালিক শাহ ছিলেন দূরদর্শী শাসক। রাজকার্যের সুবিধার জন্য প্রচলিত চন্দ্র পঞ্জিকার সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে তিনি খৈয়ামকে একটি সৌরপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। খৈয়ামসহ আরও আটজন বিশেষজ্ঞ মিলে ১০৭৫ সালে প্রথম পৃথিবীতে সৌরপঞ্জিকা প্রণয়ন করেন এবং মালিক শাহের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় আততারিখ আল জালালি অব্দ, তারিখ জালালি বা ‘যি যি মালিক শাহী’। রোমান ইতিহাসেও এ পঞ্জিকাকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সমকক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার সূচনা খৈয়াম প্রণিত পঞ্জিকার অনেক পরে খৈয়াম পঞ্জিকার আদলে হয়েছিল। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা বর্তমানে সারা পৃথিবীর জন্য গ্রাহ্য পঞ্জিকা হলেও প্রথমে তা ছিল খ্রিস্টীয় সাল গণনার একটি ধর্মীয় পঞ্জিকা। 

 

কবির কালজয়ী রচনা রুবাই

প্রতিটি রুবাইতে একটি মাত্র ভাবকে অবলম্বন করে প্রকাশ করা হয় দ্রোহ, প্রেম, আনন্দ, বিষাদ। মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মণিমুক্তা বলে অভিহিত করেছেন

ফার্সি সাহিত্যের কাব্যকে প্রধানত ভাগ করা যায় চার শ্রেণিতে- কাসিদা (রঙ্গ বা ব্যঙ্গ কাব্য), গজল (প্রেমগীতি), মথনবী বা মসনবী (দীর্ঘ কাব্যগাথা) এবং রুবাই। রুবাই একবচন। বহুবচনে রুবাইয়াত। রুবাই হচ্ছে চতুষ্পদী কবিতা, চার চরণে সীমাবদ্ধ। প্রতিটি রুবাইতে একটি মাত্র ভাবকে অবলম্বন করে প্রকাশ করা হয় দ্রোহ, প্রেম, আনন্দ, বিষাদ। মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মণিমুক্তা বলে অভিহিত করেছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চার পঙ্ক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয় ১৮৫৯ সালে। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের এই অনুবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ অনুবাদের মাধ্যমে ফিটজেরাল্ড নিজেও খ্যাতিমান হয়েছেন। তাঁর অনুবাদ বইটি ১০ বারেরও বেশি এডিশন বের হয়েছে। ওমর খৈয়াম সম্পর্কে এবং তাঁর লেখাগুলো নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বই লিখিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ফার্সি কাব্যজগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নীরব কবিদের মনের কথা বলেছেন, যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার নামে বা তাঁর কবিতার অনুবাদের নামে নিজেদের কথাই প্রচার করেছেন। আবার কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার মধ্যে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন।

 

ছিল অতৃপ্তিও

প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।’ কিন্তু ‘লেখা’মাত্রই সেই স্থায়িত্ব পায় না। তবে ওমন খৈয়াম জ্বলজ্বল করছেন মানুষের মনে। কারণ তিনি মানুষের মনে জীবনের বোধ তৈরি করে গেছেন। এত কিছুর পরেও তাঁর ভিতর ছিল অতৃপ্তি। ছিল অজানাকে জানার দুর্বার আকাক্সক্ষা। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের অনেক কঠিন রহস্য বা প্রশ্নের সমাধান দিয়ে গেলেও অনেক অজানা বা রহস্যময় বিষয়গুলোর সমাধান জানতে না পারায় আক্ষেপ করে গেছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, জীবন এবং জগতের ও পারলৌকিক জীবনের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন ওমর খৈয়াম।

এসব প্রশ্ন মানব সভ্যতার বিকাশে কিছু মৌলিক প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন, এসব জিজ্ঞাসা যুগে যুগে জ্ঞান-তৃষ্ণার্ত বা অনুসন্ধানী মানুষের মনের প্রশান্ত সাগরেও তুলেছে অশান্ত ঝড়। দার্শনিকরা মূলত এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। কারণ দর্শনের যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হলেও তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না খৈয়াম তা কবিতার অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে ওমর খৈয়ামের চার লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুলো কবিতা জগতে হয়ে উঠেছে অনন্য। সমাজের পদে পদে তিনি আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে গেছেন কীভাবে হাঁটতে হয় জ্ঞানের দরজা খুলে। তিনি অতৃপ্তি নিয়ে হেঁটেছেন জ্ঞানের সীমাহীন পথে।

 

ওমর খৈয়ামের বাণী

♦ এমন একটা দরজা যার কোনো চাবি খুঁজে পাইনি, কারণ এমন একটা পর্দা ছিল যার কারণে আমি দেখতে পাইনি।

♦ এক টুকরো রুটি, একটি শুরার পাত্র এবং তুমি।

♦ একটি চলমান আঙুল লিখছে এবং লেখাটা চলমান আছে। যার পুরোটাই তোমার বুদ্ধিমত্তা যেমন নয়, তেমনি পুরোটাই পবিত্র নয়; যে কোনো একটা বাদ দিতেই পার।   

♦ যখন আমি আজকের সম্পর্কে জানতে চাই অথবা আগামীকাল সম্পর্কে; আমি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই।

♦ জ্ঞানের সুধা পান কর, তুমি কোথা থেকে এসেছ এবং কেন! পান কর জানার জন্য- তুমি কেন যাচ্ছ এবং কোথায়!  

♦ যে ফুলটি প্রস্ফুটিত হলো একসময় তাকে মরতেই হবে।

♦ সত্য ও মিথ্যার মধ্যবর্তী দূরত্ব হলো এক চুল পরিমাণ।

♦ মন্দির যদি মানুষের ভিতরেই থাকে, তাহলে পূজারিরা বাইরে মাথা ঝাঁকায় কেন?

♦ আস্তিনের ধুলা ঝাড়ো যত্ন নিয়ে, একদিন এই ধুলাই ছিল সুন্দর একটি মুখ।

♦ যদি শান্তি ও নির্মলতায় পৌঁছতে চাও তাহলে পুরো পৃথিবীর বেদনা ঝেড়ে ফেল।

♦ চলমান আঙুল লিখে চলে, লিখে চলে আদেশপত্র।

 

সর্বশেষ খবর