১৯৮৬ সালে ঘরোয়া ফুটবলে সুপার লিগে আবাহনীর বিপক্ষে মোহামেডানের ম্যাচ। টানা চারবার লিগ জিততে আবাহনী উড়িয়ে এনেছিল গোলরক্ষক ভাস্কর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ধর ও কলকাতা লিগে খেলা নাইজেরিয়ান চিমা ওকোরিকে। এমন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে জেতা অসম্ভব বলেই মোহামেডান আগাম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ম্যাচ শেষে তারা ক্লাবে ফিরবে না। যে যার মতো নিরাপদ স্থানে চলে যাবেন। কেননা টানা তিনবার লিগে ব্যর্থতার পর সমর্থকরা এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, ফের ব্যর্থ হলেই খেলোয়াড়দের দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল আবাহনী তিন শক্তিশালী বিদেশি উড়িয়ে আনার পর। অনেকে ভেবেছিলেন হয় আবাহনী জিতবে। না হয় ড্র করে টানা চতুর্থ শিরোপার দিকে এগিয়ে যাবে।
সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে মোহামেডান জিতেই শিরোপার পথে এগিয়ে যায়। শেষ ম্যাচে ওয়ান্ডারার্সকে হারিয়ে তিন মৌসুম পর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সাদা-কালোরা। আবাহনীর বিপক্ষে না জিতলে কী যে হতো তা এখনো ভাবলে সাবেকরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। টানা তিন বছর লিগ জেতায় তখন মোহামেডানের ভয় ও চরম অস্থিরতা নেমে এসেছিল। অথচ সেই দল দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ব্যর্থ। পেশাদার লিগে আবাহনী তো আছেই অভিষেক আসর থেকে ট্রফি জিতে শোকেস ভরিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। এমনকি শেখ জামাল ধানমন্ডি ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রও লিগ জিতেছে। মোহামেডান শিরোপা তো দূরের কথা মাঝে মধ্যে রেলিগেশনের শঙ্কাও ছিল।
দীর্ঘ ২৩ বছর লিগ না জেতার পরও সমর্থকরা ছিলেন নিশ্চুপ। ৭০ ও ৮০ দশকের ফুটবলে ক্রেজটা ছিল না বলেই রক্ষা। ঘরোয়া ফুটবলে আগের সেই জনপ্রিয়তা থাকলে মোহামেডান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা ভাবলেও ভয় হয়। যাক এতদিন পর বন্ধ দুয়ার খুলেছে ঐতিহ্যবাহী দলটির। ২৩ বছরে জাতীয় লিগ, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ ও সুপার কাপ জিতলেও দেশের ফুটবলে সবচেয়ে মর্যাদাকর আসর লিগটা ছিল অধরা। পেশাদার লিগে শিরোপার ট্রফি মোহামেডানের ঘরে যাবে তা স্বপ্নে পরিণত হয়। সেই স্বপ্ন পূরণের অবসান ঘটেছে।
পেশাদার লিগে নতুন চ্যাম্পিয়ন হয়ে ট্রফি জিতেছে। সেই ট্রফি গতকাল হোম ভেন্যু কুমিল্লাতে বুঝে পেয়েছে সাদা-কালোরা। শিরোপা নিশ্চিত হয়েছে তিন ম্যাচ আগেই। ট্রফি ঘরে আসায় উৎসবের পূর্ণতা পেল সাদা-কালোরর। এমন ব্যর্থতার পর এ সাফল্য যেন মোহামেডানকে নতুন জীবন দিল। লিগের জৌলুস আগের মতো না থাকলেও ঘরোয়া আসরে ফুটবলই তো প্রাণ। বিশেষ করে আবাহনী, মোহামেডান ও বসুন্ধরা কিংসের কাছে গুরুত্বই আলাদা। সেই লিগের ট্রফি আসাটা নিঃসন্দেহে মোহামেডানের কাছে অনেক বড় কিছু।
এ ট্রফি সাদা-কালোদের সামনের পথ চলতে নতুন অনুপ্রেরণা জোগাবে। ক্রিকেট লিগেও ২০০৯ সালের পর শিরোপা নেই। হকি লিগেও পারছে না। সব মিলিয়ে ঐতিহ্যবাহী দলের জন্য বড় ধাক্কাও বলা যায়। ফুটবলে ব্যর্থতার কারণে অনেকে মোহামেডানকে ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেছিল। ৬০ সালের পর ওয়ান্ডারার্সের সাফল্য নেই। অথচ এক সময়ে ফুটবলে তারাই ছিল নম্বর ওয়ান। বড় দলের তালিকা থেকে ওয়ান্ডারার্সের নামটি মুছে গেছে অনেক আগেই। এখন অক্সিজেনেই টিকে আছে বলা যায়। মোহামেডান যদি এভাবে হারিয়ে যেত তাহলে শুধু দল না ক্রীড়াঙ্গনেও অশনিসংকেত নেমে আসত।
ফুটবলে যে দলের শিরোপা জেতাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তারাই এখন ফুটবলে নতুন করে চ্যাম্পিয়নের খাতায় নাম লেখাল। এ যেমন বেদনার তেমনি আনন্দের। ২৩ বছর পর হলেও চেনা ঠিকানাটা তো খুঁজে পেয়েছে। ফর্টিসের কাছে আবাহনী হারার দিনই মোহামেডানের শিরোপা নিশ্চিত হয়। আনন্দে সমর্থকরা তো বটেই সাবেক খেলোয়াড়দের চোখেও অশ্রু দেখা যায়। তারা যে মনপ্রাণে দলটিকে ভালোবাসে। পিন্টু, হাফিজ উদ্দিন, প্রতাপ, টিপু, কায়কোবাদ, মঞ্জু, রামা লুসাই, বাদল রায়, আবুল, সালাম, ইলিয়াস, স্বপন, কায়সার হামিদ, মহসিন, কানন, মন্টু, সাব্বির, জুয়েল রানারা যা পেরেছেন তা দেরিতে হলেও দেখালেন দিয়াবাতেরা। ১৫ মৌসুমে যা অন্যরা পারেননি তা পেরেছেন আলফাজ আহমেদ। তার প্রশিক্ষণেই চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান। অধিনায়ক হিসেবে লিগ জিতিয়েছিলেন। এবার কোচ হয়ে, ট্রফি বিতরণের দিনে তার আনন্দটাই বাড়তি হবেই। গতকাল ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে ৩-৩ ড্র ও আগের ম্যাচে রহমতগঞ্জের কাছে হার। তবে আসল কাজটি আগেই সেরে রেখেছিল মোহামেডান। তাই তো বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি ও পেশাদার লিগ কমিটির চেয়ারম্যান ইমরুল হাসানের হাত থেকে অধিনায়ক সুলেমান দিয়াবাতে স্বপ্নের ট্রফি নেওয়ার পর ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সে কি আনন্দ। দিনটি আবার কুমিল্লাবাসীর জন্য গর্বেরও। কারণ মোহামেডান তাদের ঘরেই পেশাদার লিগে প্রথম ট্রফি জেতার উল্লাস করল। এখন আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পারবে কি সাদা-কালোরা।