পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় আবারও উড়ল বাংলাদেশের পতাকা। বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে হেঁটে এভারেস্টের চূড়ায় উঠে অনন্য ইতিহাস গড়েছেন বাংলাদেশের পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামের সন্তান ইকরামুল হাসান শাকিল। শাকিলের এ দুঃসাহসিক অভিযানের নামকরণ করা হয়েছে ‘সি টু সামিট এভারেস্ট অভিযান-২০২৫’। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সিগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান পঞ্চগড়। পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করেন ভারতে। দেশটির জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে গত ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। এভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গত ২৯ এপ্রিল এভারেস্ট বেজক্যাম্পে পৌঁছান ইকরামুল হাসান। এরপর মূল অভিযানের জন্য বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান ১৬ মে। পরদিন ১৭ মে ক্যাম্প-৩ ও ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প-৪ এ। এ ক্যাম্প থেকেই চূড়ান্ত যাত্রা করে ১৯ মে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টায় এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান শাকিল। যাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইকরামুল হাসান বলেন, ‘ক্যাম্প-৪ থেকে যাওয়ার সময়ই প্রচুর বাতাস আর তুষারপাতের মধ্যে পড়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল চূড়ায় পৌঁছাতে পারব তো। আশঙ্কা নিয়েই ধীরে ধীরে চূড়ার দিকে যাই। হিলারি স্টেপের (চূড়ার কাছাকাছি জায়গা) কাছে পর্বতারোহীদের ডেডবডি (মৃতদেহ) দেখলাম। এর মধ্যে সম্প্রতি মারা গেছেন এমন দেহও দেখেছি।’ সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজের প্রিয় বাংলাদেশের পতাকা উড়ালেন শাকিল। ২২ মে এভারেস্ট জয়ের আকাক্সিক্ষত ছবি ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছেন তিনি। ছবিটির সঙ্গে অভিযানের অভিজ্ঞতাও সংক্ষেপে লিখেছেন তিনি। সেখানে বলেছেন, ‘১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ৬টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপর বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা।
পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই, আমি তখন হাজারও আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কেঁদেছি... কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে আর দায়িত্ববোধে। এ আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের আর সেসব তরুণের যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর। এটা তাদের, যারা বিশ্বাস করেছিল আমার স্বপ্নে। এটা তাদের, যারা আমাকে শিখিয়েছে, ‘অসম্ভব’ শব্দটা শুধুই একটি দেরিতে মানা ব্যর্থতা। এভারেস্টের চূড়া থেকেই বলছি, সাহস থাকলে, পরিশ্রম থাকলে আর দেশের জন্য ভালোবাসা থাকলে, কোনো স্বপ্নই দূর থেকে যায় না।’ তাঁর এ অভিযান শুধু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নয়, বরং এর পেছনে ছিল একটি গভীর বার্তা- ‘একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ কমানো।’ পুরো পথজুড়েই শাকিল এ বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ ও ভ্রমণসঙ্গীদের মাঝে। ৯০ দিনের মধ্যে সামিট জয়ের লক্ষ্য ঠিক করলেও শাকিল ৮৪ দিনেই তা শেষ করেছেন। এতে আরেক পবর্তারোহী অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যাকার্টনির রেকর্ড ভেঙেছেন শাকিল। ম্যাকার্টনি ১৯৯০ সালে তিন মাসের বেশি সময় নিয়ে ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে পদযাত্রা করে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন। পর্বতারোহণ ও দুঃসাহসিক অভিযানে এর আগেও শাকিল ইতিহাস গড়েছেন। তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন নেপালের গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল, যা প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ৩৩ জন এ ট্রেইল সম্পন্ন করেছেন, যাদের মধ্যে শাকিলই একমাত্র বাংলাদেশি।