শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের যত যুদ্ধ

সাইফ ইমন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের যত যুদ্ধ

ইউক্রেনে সম্প্র্রতি সেনা অভিযান চালিয়েছে রাশিয়া। যার বিরোধিতা করছেন বিশ্ব নেতারা। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বিশ্বের নানা দেশেই এমন সেনা অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কিছুদিন আগেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে মার্কিন সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর ইতিহাসে ১৭টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

আলোচিত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সূচনা ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে।  জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কিছু যুদ্ধ নিয়েই আজকের রকমারি...

 

ইরাক-ইরান যুদ্ধ

ইরাক-ইরান যুদ্ধের সূচনা ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। ইরানের কাছে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এবং পবিত্র প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এ যুদ্ধকে ব্যাটল অব কাদেসিয়া নামে অভিহিত করতেন।

সীমান্ত বিরোধ এবং ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া জঙ্গিদের ইরানি মদদ দেওয়ার অভিযোগে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানি ভূখণ্ডে আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ চালায়। এরা আগে ঘটে যাওয়া ইরানি ইসলামী বিপ্লবের নাজুক অবস্থাকে ব্যবহার করে ইরাক যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কার্যত সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৮২ সালের জুনের মধ্যে ইরান তার হারানো সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরের ছয় বছর ইরানি বাহিনী যুদ্ধে অগ্রসর ভূমিকায় ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলের সঙ্গে এ যুদ্ধের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পরিখা, কাঁটাতার, মানব স্রোত, বেয়োনেট চার্জ এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানি সৈন্য, বেসামরিক নাগরিক এবং ইরাকি কুর্দিদের ওপর রাসায়নিক গ্যাস এবং মাস্টারড গ্যাস প্রয়োগ করে। সর্ব প্রথম ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বিমান বাহিনী ইরানের ১০টি বিমান বাহিনীর ঘাঁটির ওপর অতর্কিত পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালায়। এদিকে ইরানের তেল সমৃদ্ধ খুজেস্তান প্রদেশ ইরাক দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে ইরান চরমভাবে বিপর্যস্ত হবে এবং এই বিপর্যয় তেহরানের সরকারের পতন ত্বরান্বিত করবে, এমন ভাবনা থেকে সাদ্দাম হোসেন খুজেস্তানের ওপর পূর্ণমাত্রার অভিযান শুরু করে। ইরাকের আরও দুটি ডিভিশন মধ্যবর্তী ফ্রন্টে আক্রমণ পরিচালনা করে। ইরাকের অতর্কিত আক্রমণ ইরানের জন্য ছিল বিস্ময়কর। ফলে বিভিন্ন স্থানে ইরানের নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনী পাসদারান প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা করে। তবে, বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া এই প্রতিরোধের মাঝে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় না থাকায় ইরাকি বাহিনীকে শুরুতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। জাতিসংঘের বারবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৩ সালে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধবন্দি বিনিময় ঘটে। যুদ্ধে অনেক ইরানি বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়।

 

চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তুরস্কের মধ্যস্থতায় আলোচনা

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়া। শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে তাদের নিজস্ব সরকারকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়েছিল। পরে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করে তাদের সেনাবাহিনী কিয়েভের কাছে কিয়েভ হস্তোমেল বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। এরপরই কিয়েভের চারপাশ থেকে ঢোকা রুশ সৈন্যদের প্রতিহত করতে শহরে ঢুকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সামরিক যান।

এদিকে যুদ্ধ শুরুর দুই সপ্তাহ পর তুরস্কের মধ্যস্থতায় আলোচনায় বসতে সম্মত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। সংকট সমাধানের জন্য আলোচনায় বসতে তুরস্কে পৌঁছেছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা। ইউক্রেনের একটি টেলিভিশন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে তুরস্কের আন্তালিয়ায় গতকাল এ বৈঠক হয়। তবে কোনো ধরনের বড় সমঝোতা ছাড়াই শান্তি আলোচনা শেষ হয়। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দরজা খুলবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। অবশ্য সাময়িক যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গত বুধবার ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মারিউপোল শহরে হাসপাতালে রাশিয়ার বোমা হামলা হয়েছে। রাজধানী কিয়েভের আশপাশে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। আগের দুই দিনও দুই পক্ষের লড়াইয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হলেও রাশিয়ার বিপক্ষে কোনো ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়নি দেশটি। বেলারুশ সীমান্তে তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসেও এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি রাশিয়া ও ইউক্রেন। অন্যদিকে রাশিয়ার সেনা কমান্ডার ও দেশটির বড় সরকারি কর্মকর্তাদের ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হবে- এমনটাই বলেছেন ব্রিটেনের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হিপ্পি। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের মনে রাখা প্রয়োজন কেবল রাশিয়ার শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারাই নয়, তারাও আদেশ মানতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধে জড়াচ্ছেন। তাদেরও জনগণ জবাবদিহিতার মুখোমুখি করবে।’

 

আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধ

আফগানিস্তান অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। প্রথমে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে বরাবরই লড়াই করে গেছেন আফগানরা। বিশ্বের সব পরাশক্তির সঙ্গে তালেবান গোষ্ঠীর লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ধ্বংসপ্রায়। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান কিংবা আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটি লক্ষ্য অনেক বছর আগেই অর্জিত হয়েছে। গত বছর শেষে মার্কিন সেনারা ত্যাগ করে আফগানিস্তান। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তিঘেঁষা একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল; যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর জবাব দিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।

 

ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ

শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইরাক পরাস্ত হয়েছিল। কুয়েত মুক্ত হয়েছিল ইরাকি দখলদারিত্ব থেকে

১৯৯০ সালের ২ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে ইরাক তার তেলসমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশ কুয়েতে আক্রমণ করে। হঠাৎ এ হামলার ফলে কুয়েতের সেনাবাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দেশটি দখল করে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কুয়েতের মানুষ হতভম্ব। চারদিকে বিভ্রান্তি। ইরাক এবং কুয়েতের মধ্যে বহু বছর ধরে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ চলছিল। দুটি দেশই তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। ইরাকের অভিযোগ ছিল, কুয়েত অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ধস নামাচ্ছে। হামলা শুরুর দুই দিনের মধ্যে কুয়েতি প্রতিরক্ষা বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই আগ্রাসন স্থায়ী ছিল সাত মাস। দুই দেশের সম্পর্কে আরও সমস্যা তৈরি করেছিল ১৪০০ কোটি ডলারের এক ঋণ। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইরাক এই অর্থ ধার করেছিল কুয়েতের কাছ থেকে।  তখন কুয়েতের মোট জনসংখ্যা মাত্র ২১ লাখ। বেশির ভাগ বিদেশি সঙ্গে সঙ্গেই কুয়েত ছেড়ে চলে যান। আর কুয়েতের নাগরিকদেরও দুই-তৃতীয়াংশ দেশ ছেড়ে পালান। ইরাকের জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে কুয়েত থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘের সম্মিলিত সামরিক  জোট সামরিক হস্তক্ষেপ করে।

শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইরাক পরাস্ত হয়েছিল। কুয়েত মুক্ত হয়েছিল ইরাকি দখলদারিত্ব থেকে। তবে কুয়েত যতদিন ইরাকের দখলে ছিল, তখন ১ হাজারের মতো কুয়েতে নাগরিক লড়াইয়ে নিহত হয়। ৬০০ জনের মতো গুম হয়। যুদ্ধে ইরাকেরও হাজার হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়।

 

সৌদি আরবের আগ্রাসন ইয়েমেনে

২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে সৌদি আরব ও কয়েকটি আরব দেশ ইয়েমেনের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। এতে এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত ও কয়েক লাখ মানুষ আহত হয়েছে। এ ছাড়া, ঘর-বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, খাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানসহ অগণিত অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। দেশটিতে এখন মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ইয়েমেনের লড়াইয়ের শুরুটা হয় আরব বসন্ত দিয়ে, যার মাধ্যমে আসলে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। ২০১১ সালে দেশটির দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকে তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদিকে অনেক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সানা দখল করে নেয় হুতিরা। ফলে ইয়েমেনে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি সরকার পক্ষ, আরেকটি হুতি বিদ্রোহীরা। আলী আবদুল্লাহ সালেহর সমর্থক সেনারাও হাত মিলিয়েছিল হুতিদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সমর্থনে এই বিমান হামলা শুরু হয়। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হাদি এই অভিযানে সমর্থন দেন।

 

ইতিহাসের কুখ্যাত ভিয়েতনাম যুদ্ধ

পৃথিবীর ইতিহাসে গণহত্যার জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে। এ যুদ্ধ এখনো মানুষকে আন্দোলিত করে, শিহরিত করে আর শান্তির পথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও পরাশক্তি মানা হয় আমেরিকাকে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর ভয়াবহতম যুদ্ধগুলোর সঙ্গে আমেরিকার কোনো না কোনো  যোগসাজশ ছিল। তবে তাদের সংশ্লিষ্টতায় অধিকাংশ যুদ্ধেই আমেরিকানরা জয়ের স্বাদ  পেয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ হচ্ছে প্রথম যুদ্ধ, যাতে আমেরিকা হেরে যায়। এ যুদ্ধকে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় সংঘাত হিসেবে মানা হয়। এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল আমেরিকানদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। অর্থাৎ সাম্যবাদী শাসন বা কমিউনিজম যেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে না পারে সে জন্যই আমেরিকা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম আর উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে। মাঝখান থেকে আমেরিকা যুক্ত হলে যুদ্ধ তার গতিপথ পরিবর্তন করে এবং ভয়াবহ রূপ নেয়। আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে ১৯৬৫ সালে সেখানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু এর ফলে  যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, তাতে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারেনি।

 

২০১১ থেকে সিরিয়া যুদ্ধ

বর্তমানে সিরিয়া আর ইরাকের যুদ্ধ বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ইসলামিক স্টেট  ঘোষণা করা সিরিয়ার তেলের যে ভাণ্ডার তার প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর লালায়িত চোখ বহু আগে থেকেই। বাশার সরকার পতনের লক্ষ্যে ২০১১ সালের জুলাইয়ে সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহীদের ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠনের মধ্য দিয়েই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপর সশস্ত্র সংঘাত ভয়ংকর রূপ নেয়। একই বছরের অক্টোবরে সরকারি সেনার ওপর ট্যাংক এবং হেলিকপ্টার সহযোগে প্রথম হামলা চালায় কোম শহর দখল করার জন্য। এরপর থেকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি দেশের অনেক অংশ দখল করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদেশিদের নগ্ন হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ২০১৫ সালে রাশিয়ার সরব উপস্থিতি। ইরান, ইরাক ও লেবাননের হিজবুল্লাহ বাশার আল-আসাদকে সমর্থন-সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে তুরস্ক, কাতার এবং সৌদি আরব আসাদ বিরোধীদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। ২০১৬ সালে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সিরিয়ায় পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি  গেড়ে বসে। এই যুদ্ধে তেলের যে বিরাট ভূমিকা আছে তা মোটামুটিভাবে সন্দেহাতীত। কথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের আয়ের বড় উৎস তেল সম্পদ। তারা সিরিয়া তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করে।

২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ডলারের তেল বিক্রি করত বলে ধারণা করা হয়।

 

ফ্রান্স বধ হলেও মালির যুদ্ধ এখনো চলমান

২০১২ সালে, মালির জিহাদি সমস্যা মূলত দেশটির উত্তরের দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল। মালির পাশেই রয়েছে সাহারা মরুভূমি, প্রতিবেশী হিসেবে সাহারা খুব সুখকর জায়গা নয়। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির পতনের পর মালির সেনাবাহিনীর পক্ষে এই বিশাল মরু অঞ্চল এককভাবে পাহারা দেওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠেছে, যাদের হাতে আবার পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রও নেই। এর ফলে দেখা গেল, মালিতে সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতাশূন্যতা সৃষ্টি হলো, যার মধ্যে তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদী এমএনএলএও তাদের জিহাদি সঙ্গীরা ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সের সেই হস্তক্ষেপের আড়াই বছর পর মালি ও তার আন্তর্জাতিক সঙ্গীরা দেশটি পুনর্র্নিমাণে কাজ করছে। ফরাসি সেনাদের ওই এলাকার সিংহভাগ পুনর্দখল করতে মাত্র ২৩ দিন সময় লেগেছিল। এরপর দেশটিতে ২০১৩ সালে নির্বাচন হলো, তার মাধ্যমে ক্যারিশম্যাটিক ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক ইব্রাহিম বুবাকার কেইতা আবারও ক্ষমতায় আসেন। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে বিদ্রোহী জোট ও সিএমএর মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি হয়। কিন্তু মালির অবস্থা ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো নয়, সেখানকার দ্বন্দ্ব পুরোপুরি শেষ হয়নি। দেশটির উত্তরে এখনো বিভিন্ন নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, একিউআইএম ছাড়াও জিহাদি আল-মুরাবিতুন ও আনসার দ্বীন সেখানে রয়েছে, আবার  সেখানে সরকারপন্থি জঙ্গি বাহিনীও রয়েছে। ফলে সেখানে জাতিসংঘের কাজও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে জিহাদিরা এসব হামলা চালালেও সব সময় যে তারাই এই হামলা চালায়, ব্যাপারটা সে রকম নয় যে জিহাদিদের সঙ্গে একিউআইএমের সম্পর্ক আছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই যোদ্ধারা অনায়াসে এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীতে চলে যাচ্ছে, তারা জিহাদি গোষ্ঠী থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যাচ্ছে আবার ফেরতও আসছে,  তা সেসব গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন।

সর্বশেষ খবর