বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অপরাধ দমনে সাংবাদিকতার ভূমিকা

ড. জিয়া রহমান, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অপরাধ দমনে সাংবাদিকতার ভূমিকা

সাংবাদিকরা বিভিন্ন ঘটনা অনুসন্ধান করার মাধ্যমে অপরাধ দমনে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। অপরাধের তদন্তেও তারা পুলিশকে সহায়তা করে থাকেন। পুলিশ যেমন নিজেদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনে তেমনি সাংবাদিকরা মানুষের কল্যাণে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারেন।  গণমাধ্যমে অপরাধ ও দুর্নীতি সম্পর্কিত তথ্য প্রতিবেদন উপস্থাপনের প্রতিফলন হিসেবেই পরবর্তীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

 

প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানান অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিটি সমাজের অপরাধ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন যেমন পাল্টেছে তেমনি এর পরিধিও বেড়ে চলেছে। প্রাথমিকভাবে সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতা শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব হিসেবে দেখা হলেও সামাজিক সমস্যাগুলো বিশ্লেষণের জন্য সাংবাদিকতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।  বিল কোভাচ ও টম রোসেন্টিয়েল দ্য এলিমেন্টস অব জার্নালিজম গ্রন্থে সাংবাদিকতাকে ‘A practical and functional form of truth’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

সাংবাদিকতার মাধ্যমে অপরাধ জগতের বিভিন্ন সিন্ডিকেটের খবরসহ করপোরেট অনিয়মজনিত নানা বিষয় উদঘাটিত হয়েছে।  সমাজের ভোক্তা সাধারণের অধিকার খর্ব করার প্রক্রিয়া, দেশের সীমান্তে চোরাচালানের তথ্য, পরিবেশ দূষণের কারণসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনা জনগণের সামনে তুলে ধরার পেছনে সাংবাদিকদের নিরলস পরিশ্রম রয়েছে। অপরাধ তদন্তে সাংবাদিকদের দুঃসাহসিক অনেক ঘটনার নজির রয়েছে। যেমন- ১৮৭২ সালের মাঝামাঝিতে জুলুস চেম্বার্স নামের নিউইয়র্ক ট্রিবিউনের এক সাংবাদিক মানসিক হাসপাতালের ভিতরে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, কীভাবে সেখানে মানসিক বিকারগ্রস্তদের রাখা হচ্ছে, তা জানার জন্য নিজেই মানসিক রোগী সেজে ভর্তি হয়ে যান ব্লুমিংদাল এসাইলাম নামের শহরের এক মানসিক হাসপাতালে। তিনি পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারেন অন্তত ১২ জন লোককে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে যারা অসুস্থ বা মানসিক বিকারগ্রস্ত নয়। খবর ছাপার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু হয় এবং প্রমাণিত হয় তার অভিযোগের সত্যতা। পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মুক্তি পায় সেই ১২ জন রোগী, যারা সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে সেই হাসপাতালে ছিলেন। এ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আমেরিকান সরকার তাদের দেশের লুনাসি অ্যাক্ট বা পাগলামি আইনে পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য হয়। সাংবাদিকতার দৃশ্যমান প্রভাবের আরেকটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি ঘটনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

এভাবেই সাংবাদিকরা বিভিন্ন ঘটনা অনুসন্ধান করার মাধ্যমে অপরাধ দমনে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। অপরাধের তদন্তেও তারা পুলিশকে সহায়তা করে থাকেন। পুলিশ যেমন নিজেদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনে তেমনি সাংবাদিকরা মানুষের কল্যাণে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারেন। গণমাধ্যমে অপরাধ ও দুর্নীতি সম্পর্কিত তথ্য প্রতিবেদন উপস্থাপনের প্রতিফলন হিসেবেই পরবর্তীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ২০১৭ সালে আদনান কবির হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে কিশোর গ্যাং অপরাধের চিত্র উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করলেও এই অপরাধের বিস্তারিত তদন্তে সাংবাদিকরাও সাহসী ভূমিকার প্রশংসার দাবিদার। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের ধরন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণ, এই অপরাধের বিস্তারসহ নানান দিক উদঘাটনে সাংবাদিকদের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকরা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে এই ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। এসব রিপোর্ট পরিবারভিত্তিক বা সমাজভিত্তিক এহেন অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে কিশোরদের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি এসব অপরাধ সংঘটনের কারণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যালোচনা করে থাকেন সাংবাদিকরা। এভাবে সমাজের সব অপরাধ প্রতিরোধের সঙ্গে চিরতরে অপরাধ দমনের জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতিগুলো পরিবর্তন ও পরিমার্জনেও সাংবাদিকরা অসামান্য অবদান রাখেন।

অনুসন্ধান সাংবাদিকতার মাধ্যমে সাংবাদিকরা অপরাধ জগতের নিগূঢ় সত্য তুলে আনার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং চাকরির প্রশ্ন ফাঁস সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও এর পেছনে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গের নাম সাংবাদিকরা তুলে ধরেন এবং পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাদকদ্রব্য পাচার সম্পর্কিত অনুসন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও মাদকদ্রব্য পাচারের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অপরাধ চক্রের তথ্য জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করছেন। অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদের নিয়ে পুলিশ প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এ অপরাধের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাদক চোরাচালানের প্রকৃতি, মাদক সেবনকারীদের বিশেষত, তরুণ-তরুণীদের ওপর মাদকের নেতিবাচক প্রভাব এবং তরুণ সমাজের অবক্ষয়ের কারণগুলো নিয়ে সাংবাদিকরা বিভিন্ন তদন্তমূলক প্রতিবেদন জনসম্মুখে তুলে ধরছেন। বর্তমানে এভাবেই অপরাধ দমনে পুলিশ এবং সাংবাদিকরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছেন।

এ ছাড়াও সাংবাদিকরা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন- অ্যাসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির ওপরে পুনঃ আলোকপাতের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করেন। ফলস্বরূপ, বর্তমানে এসব অপরাধ সমাজ থেকে অনেকাংশে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। অতএব, গণমাধ্যম যত বেশি শক্তিশালী হবে সমাজের ন্যায়ের শাসন তত বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি দেশের গণমাধ্যম যদি সমাজের সমস্যা এবং অপরাধ আলোকপাতের ক্ষেত্রে সরব ভূমিকা পালন না করে তা জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতার নীরবতা একটি দেশকে গণহত্যার মতো অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার উদাহরণস্বরূপ আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন এবং মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

সাংবাদিকতার মাধ্যমে একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হতে পারে। সংকটকালীন সমাজে বিভিন্ন অপরাধচক্র অথবা দুর্নীতির আবির্ভাব ঘটতে পারে। বিশ্ব সংকট, কভিডকালীন সামাজিক অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বিভিন্ন চক্র তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করে। মহামারিকালে আমরা ভুয়া কভিড সনদ ব্যবহার, নকল চিকিৎসাসামগ্রী বিক্রয়সহ ইত্যাদি অভিনব অপরাধের সূচনা দেখি। সমাজের ক্রান্তিকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব অপরাধ উদঘাটন এবং জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনে সাংবাদিকরা জনসাধারণ এবং সরকারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন। জনসাধারণের মতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে এবং সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সংবাদ উপস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক সংস্কারেও সাংবাদিকরা গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন অপরাধ অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান যেমন- ইনভেস্টিগেশন ৩৬০, ক্রাইম সিন, তালাশ, খোঁজ ইত্যাদি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সাংবাদিকরা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধের বিশ্লেষণ করছেন। দেশের সীমানা এলাকাতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন অপরাধ থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধ সংগঠন কর্তৃক সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের টার্গেট গ্রুপ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা বর্তমানে অপরাধ বিশ্লেষণ এবং দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের দৃশ্যপট ছাড়াও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং অপরাধ দমনে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে সাংবাদিকরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বদরবারে সেসব দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলো এবং বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যের সত্যতা মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। সাম্প্রতিক তালেবান কর্তৃক দখলকৃত আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ণনা বিশ্বদরবারে তুলে ধরার মাধ্যমে সাংবাদিকরা বিশ্ব রাজনীতিকদের সমর্থন সংকলনের চেষ্টা করে চলেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিপূরক হিসেবে সাংবাদিকরা কাজ করে থাকলেও তাদের প্রতিনিয়ত নিজেদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতু সাংবাদিকরা জনসাধারণের মাঝে সতর্কতা সৃষ্টির গুরুদায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন, তাদের অবশ্যই সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত নীতি-নৈতিকতা মেনে খবর প্রচার করতে হবে। যেসব বিষয়ের ফলে সমাজে অসহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে সে ধরনের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দুঃখজনকভাবে বর্তমান যুগের একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে মিডিয়া ট্রায়াল।  কিন্তু আইনি বিচারব্যবস্থা সম্পন্ন হওয়ার আগে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচার করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।  অপরাধের অনুসন্ধানের বিষয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা এবং তদন্তের স্বার্থে গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারেও তাদের সতর্ক থাকা উচিত।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন।  অতএব, সঠিক তথ্য এবং সোর্স ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে অপরাধের উদঘাটন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমে জনসাধারণের কল্যাণের জন্যই কাজ করার দায়বদ্ধতা সাংবাদিকতার ওপর বর্তায়।

সর্বশেষ খবর