চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৬ সাল। ছাত্র শিক্ষক সবাই তখন ব্যস্ত ক্লাস নিয়ে। কলা অনুষদের দ্বিতীয় তলা থেকে ভেসে আসে চিৎকার ও কান্না। কতিপয় দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন আবুল মনসুর নামে এক ছাত্রকে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন মনসুর।
স্বাধীনতার পরবর্তী অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বলি হন এ ছাত্র। এটিই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম খুন। এ খুনের পর কেটে গেছে ৪৩ বছর। সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ হয়েছে লাশের সারি। রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার, আন্তঃকোন্দলকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে।
গত ২৮ বছরে চবিতে ২০ খুনের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডেরও।
সদ্য সাবেক হওয়া চবি’র ভিসি অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু খুনের শাস্তি নিশ্চিত করবে আদালত। যদি খুনের বিচার হলে খুনের মত ঘটনা বার বার সংগঠিত হতো না।’
চাকসু’র সাবেক ভিপি মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষক রাজনীতি ও প্রশাসনের দলবাজির কারণেই চবির কোনো খুনের বিচার হয়নি। তারা নিরপক্ষ অবস্থানে থাকলে ক্যাম্পেসের খুনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে আসতো।’
জানা যায়, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রসমাজ নেতা হামিদের হাতের কব্জি কেটে চবিতে পুরোদমে সংঘাতের রাজনীতি শুরু করে ছাত্রশিবির। এরপর থেকে গত ২৮ বছরে চবিতে ২০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিগত সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের এখনো পর্যন্ত বিচার হয়নি একটিরও। এসব হত্যাকাণ্ডের সিংহভাগেরই মূল কারণ ছিল আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও আন্তঃকোন্দল।
১৯৮৮ সালের ২৮ এপ্রিল নগরীর বটতলী স্টেশনে শিবিরের হামলায় নিহত হন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কর্মী পরিসংখ্যান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমিনুল হক। ১৯৮৮ সালে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন আইনুল হক নামে শিবিরের এক কর্মী। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর শিবিরের হামলায় নিহত হন ছাত্রমৈত্রীর কর্মী ফারুকউজ্জামান। ১৯৯৪ সালের ২৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী মাজার এলাকায় শিবির ক্যাডারদের হাতে খুন হন ছাত্রদলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুছা। ১৯৯৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কটেজে হামলা চালিয়ে খুন করা হয় আবৃত্তিকার বকুলকে। ১৯৯৮ সালের ৬ মে শাহ আমানত হলে শিবিরের হামলায় নিহত হন ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা আইয়ুব নামে এক শিক্ষার্থী। ১৯৯৮ সালের ১৮ মে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের বালুছড়া এলাকায় শহরগামী একটি শিক্ষক-বাসে শিবিরের হামলায় নিহত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মুশফিক-উস-সালেহীন। ১৯৯৮ সালের ২১ আগস্ট পুরাতন বটতলী স্টেশন এলাকায় ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্র। ১৯৯৯ সালের ১৫ মে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন শিবির কর্মী জোবায়ের। একই বছর ১৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন শিবির কর্মী রহিমুদ্দিন ও মাহমুদুল হাসান।
এছাড়াও ২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ এলাকায় শিবিরের হামলায় নিহত হন ছাত্রলীগের তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী মর্তুজা। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন মহিউদ্দিন মাসুম। ২৯ মার্চ ফতেয়াবাদ এলাকায় রেললাইনের পাশে হারুনর রশিদ নামে এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছর ১৫ এপ্রিল নিহত হন আসাদুল ইসলাম নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী।
২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে নিহত হন মাসুদ বিন হাবিব ও মুজাহিদুল ইসলাম নামে দুই শিবির নেতা। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হন মামুন হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন