গত ২৭ এপ্রিল ছিল ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আদোপান্ত বাঙালী এই নেতা তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বার বার চড়াই-উতরাই পার হয়েছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও পিছিয়ে পড়া মজলুম মুসলমান প্রজাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। তার শিক্ষাগুরু আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ফজলুল হকের মাঝে দেখেছেন খাঁটি বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের অপূর্ব সম্মিলন। তাই বাংলার বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে রাজনীতি বিমুখ এই বিজ্ঞানী ফজলুল হকের সরকারকে সমর্থন করে যেতে আবুল মনসুর আহমদকে করজোড়ে মিনতি করেছিলেন। বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরেই চতুর্থ শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
যে সময়ে বাঙালি মুসলমান পরিবারের ছেলেরা স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারতোনা, সেই সোয়াশো বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন, হয়েছেন আইনে স্নাতক। আশুতোষ মুখার্জীর জুনিয়র হিসেবে ব্যাবহারিক জীবনের সূত্রপাত। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অলংকৃত করেছেন বহু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদ। একই সাথে হয়েছেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও মুসলিম লীগের সভাপতি। হয়েছেন কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। দেশভাগের পর হয়েছেন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী, গভর্নর। কিছুদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
এসব কিছু ছাপিয়ে দানবীর, জনহিতৈাষী রাজনীতিক শেরে বাংলা গরীব কৃষক শ্রমিকের কাছে 'আমাগো হক সাব' বলেই নন্দিত হয়েছেন। গরিব রায়তদেরকে আইন করে মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। একবার লেখক হুমায়ুন আহমেদের পিতা ফয়েজ আহমেদ কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ডিস্টিংশনসহ বিএ ডিগ্রি আছে দেখে তাকে চাকরি দিতে তিনি সসব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এমন কতজন চাকরির উমেদারের ভরসার জায়গা ছিলেন তিনি তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অভাবী মানুষের জন্য তার দরজা ছিল সবসময় খোলা। অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন তিনি। ইংরেজি, বাংলা, ও চোস্ত উর্দুতে বিরামহীন বক্তৃতায় তিনিই ছিলেন তার তুলনা। বাংলার কৃষক-মজুরের সাথে কথা বলতেন তাদেরই কথ্য ভাষায়। কথিত আছে, একবার তার ভাষণ শুনে আবেগতাড়িত হয়ে হতদরিদ্র শ্রোতাবৃন্দ দাঁড়ানো অবস্হাতে লুঙ্গির খুটি দিয়ে চোখ মুছছিলেন। সম্ভ্রম রক্ষা হচ্ছেনা দেখে শেরে বাংলা বিব্রতকন্ঠে বলে উঠলেন, "ভাইসব! কাঁদেন! আরো জোরে কাঁদেন। তবে বইস্যা কাঁদেন"।
অসুরের মত শারীরিক শক্তি ছিল তার। ছিলেন ভীষণ ভোজনরসিক। মুষ্ঠি দিয়ে ঝুনো নারকেল ভাঙা, কিংবা চৌষট্টি বছর বয়সে তিরিশটি ফজলি আম একসাথে খাওয়া, এমন অনেক কিংবদন্তী তার নামে প্রচলিত আছে। এত প্রশংসার পাশাপাশি কঠোর সমালোচনায়ও শরবিদ্ধ হয়েছেন অনেকবার। তার বার বার রাজনৈতিক দল ও অবস্হান পরিবর্তন তার অনুসারীদের বিভ্রান্ত করেছে, তার দলের নাভিশ্বাসের কারণ হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভার সাথে কোয়ালিশন তার সেক্যুলার ভাবমুর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। দেশভাগের সময় বিপরীতমুখী অবস্হানের জন্য জিন্নাহসহ তাবৎ মুসলিম লীগ নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। দেশভাগের অব্যবহিত পরে হয়েছেন পুরোপুরি অপাঙতেয়। জিন্নাহর জবানিতে তখন তার জীবনে 'ওয়াটারলু' ঘটেছিল। দীর্ঘদিন হাইবারনেশনের পর দারুণভাবে রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসেবে বিপুল বিজয় অর্জন করে পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হলেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে আবার ধরাশায়ী হন। ছেড়ে দেয়ার মানুষ ছিলেন না তিনি। কেন্দ্রের সাথে দরকষাকষি করে পূর্ব বাংলার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। তখন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অস্তগামী।
ঠিক এই সময়েই তার জীবনী লেখার আবদার করেছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। জিন্নাহর ক্যারিশমায় এককালে মোহাবিষ্ট অধ্যাপক রাজ্জাক তার স্বভাবসুলভ পুরনো ঢাকার ভাষায় বলছেন, "আমি মি: ফজলুল হকরে যাইয়া কইলাম, আমি আপনার জীবনীটা লেখবার চাই। আমার প্রস্তাব শুইন্যা খেকাইয়া উইঠ্যা কইলেন, আমার জীবনী লেখতে চাও, নিশ্চয়ই তোমার একটা মতলব আছে। আমি কইলাম, মতলবত একটা অবশ্যই আছে। হক সাহেব কইলেন, আগে হেইডা কও। আমি কইলাম, আপনে যখন গাঁও গেরামে যান, মাইনষের লগে এমন ব্যবহার করেন, তারা মনে করে জনম ভইরা আপনে গাঁও গেরামে কাটাইয়া তাগো সুখদুঃখের অংশ লইতাছেন। তারপরে গাঁও গেরাম থেইক্যা ঢাহা শহরে আইস্যা আহসান মঞ্জিলের ছাদে উইঠ্যা নওয়াব হাবিবুল্লাহর লগে যখন ঘুড্ডি উড়ান, লোকজন দেইখ্যা আপনেরে নওয়াববাড়ির ফরজন্দ মনে করে। তারপরে আবার যখন কলিকাতায় যাইয়া শ্যামাপ্রসাদের লগে গলা মিলাইয়া শ্যামাপ্রসাদরে ভাই বইল্যা ডাক দেন কলিকাতার মানুষ চিন্তা করে আপনে শ্যামাপ্রসাদের আরেকটা ভাই। বাংলার বাইরে লক্ষ্ণৌ কিংবা এলাহাবাদে গিয়া মুসলিম নাইট নবাবগো লগে যখন বয়েন, দেখলে মনে অইব আপনে তাগো একজন। এই এতগুলা ভূমিকায় আপনে এত সুন্দর সাকসেসফুল অভিনয় করতে পারেন, এইডা ত একটা মস্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতা স্যার অলিভার লরেন্সেরও নাই। এই অভিনয় ক্ষমতার একটা এনকোয়ারি আমি করবার চাই। আর নইলে আপনের আসল গুণপনা কোথায় হেইডা ত আমাগো অজানা নাই। হক সাহেব হুঙ্কার ছাইড়্যা জিগাইতে লাগল, তুমি আমার সম্পর্কে কী জান? আমি কইলাম, আপনে সুন্দর সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য মিছা কথা কইবার পারেন। আমার জবাব শুইন্যা হক সাহেব হো হো কইরা হাইস্যা উঠলেন"।
এরই ঠিক বছর দুই আগে আবুল মনসুর আহমদের ভৎর্সনার শিকার হয়েছিলেন তিনি। মূখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর কলকাতায় গিয়ে কিছু অসংগলগ্ন কথা বলায় দেশে ফিরে দেশদ্রোহিতার মামলায় গৃহবন্দী হন। এমন করুণ হাল দেখে মনসুর আহমদ বললেন, "একসময় ভাবতাম আপনি মারা গেলে জানাযায় লাখো লোকের জমায়েত হবে। আর আজ আপনি মারা গেলে পাঁচশো লোক না। জবাবে হক সাহেব বললেন "জীবনে কয়জনের উপকার করছো যে মানুষ তোমার সমালোচনা করবো। আমি তোমাগো খুশি করার জন্য এখনই মরুম না। আমি সময় মতোই মরুম"। তার ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়েছিল।
এমন বর্ণিল এক স্বপ্নচারী বাঙালির মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। বস্তুতই এ মানুষটির কাছে আমাদের অনেক ঋণ।
লেখক: অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল কবির
উপাচার্য, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ তাফসির