ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মারা যাওয়ার ছয়দিন পর ছেলের স্বপ্নের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থী বুলবুল আহমদের মা ইয়াসমিন আক্তার। সাথে ছিলেন বুলবুলের বড় ভাই, দুই বোন ও মামাসহ কয়েকজন স্বজন। ছেলেশূন্য ক্যাম্পাসে এসে অঝরে কাঁদেন মা ও বোনেরা। বিদায়ের আগে বুলবুলের ল্যাপটপসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র তার স্বজনদের হাতে তুলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে কেঁদে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে যান মা।
রবিবার সকাল ১০টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে করে বুলবুলের মা ইয়াসমিন আক্তার, বড় ভাই মো. জাকারিয়া, বড় বোন সোহাগী আক্তার ও কানিজ ফাতেমা এবং মামা কামাল আহমদসহ পরিবারের ৯ জন সদস্য শাবি ক্যাম্পাসে আসেন। এসময় তাদেরকে শাহপরাণ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান শুভেচ্ছা জানান। বুলবুল ওই হলের বি ব্লকের ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন। কিন্তু মা ইয়াসমিন আক্তার ছেলের শোক সইতে পারবেন না বলে বুলবুলের বড় ভাই জাকারিয়া তাকে হলের ভেতর বুলবুলের রুমে নিয়ে যেতে দেননি। প্রভোস্টের কার্যালয়ে বসেছিলেন শোকে বিহ্বল পরিবার। কেবলমাত্র মামা বুলবুলের রুম পরিদর্শনে যান।
জাকারিয়া বলেন, ‘বুলবুলের রুমে নিয়ে গেলে মা বেহুশ হয়ে পড়বেন। আমরাও যাইনি। আমরাও ভীষণভাবে ব্যথিত। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখানেও নিয়ে যাইনি। কারণ মা সইতে পারবেন না।’
ক্যাম্পাসে মায়ের উপস্থিতি প্রসঙ্গে জাকারিয়া বলেন, ‘মাকে আমরা আটকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। বুলবুল যেখানে থাকতো তিনি সেখানে আসতে চাচ্ছিলেন। তাই ক্যাম্পাসে নিয়ে আসি। আমরা দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল বুলবুল। সে খুব আদরের ছিল। আটমাস আগে বাবা মারা যান। এ অবস্থায় অনেক কষ্ট করে তাকে পড়ালেখা করাচ্ছিলাম। বুলবুলের পড়ালেখার খরচ যোগানোর জন্য আমার বোন বিয়ে পর্যন্ত করেনি।
শাহপরাণ হল প্রভোস্ট কার্যালয়ে বসে মা ইয়াসমিন বেগম অঝরে কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে বলেন, ‘আমার পুত আর পাইতাম না গো। আমার পুত আমায় মা ডাকে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। আজ যদি আমার ছেলে ঝালমুড়িও বেচত তাইলি কি মারা যেত? কেউ কি খুন করতো? ভালোভাবে তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার চাই। জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
বুলবুলের শোকাহত বোন সোহাগী আক্তার বলেন, ‘যারা এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে তাদেরকে রিমান্ডে নেওয়া হোক। গ্রেফতারকৃতরা সবাই রাজমিস্ত্রি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে খুন করে ফেলবে এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারো হাত আছে। তার আঘাত দেখে মনে হয়েছে তার উপর কারো ক্ষোভ ছিল। এমনও হতে পারে কেউ ওদেরক টাকা দিয়ে খুন করিয়েছে। তাদেরকে রিমান্ডে নেওয়া হোক। তাহলে সব সত্য বের হয়ে যাবে।’
বড়ভাই জাকারিয়া বলেন, ‘বুলবুল হত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ওই মেয়ে। কিন্তু আজকে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আমি বুঝতেছি না মেয়েটিকে কেনো আড়াল করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, সপ্তাহখানেক পরে নাকি কথা বলা যাবে। আমার ভাই হারিয়েছি। তার অন্তিম সময়ে সেই মেয়েটিই কাছে ছিল। তার কাছ থেকে দুটি কথা শুনতে পারতাম, কি ছিল তার শেষ কথা?’
শাহপরাণ হল থেকে বুলবুলের পরিবারকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় প্রক্টরের সঙ্গে কথা হয় পরিবারের। এসময় ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক আমিনা পারভীন উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে বুলবুলের পরিবারের সদস্যরা পৌনে ২ টায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
ছাত্রকল্যাণ উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক আমিনা পারভীন বলেন, ‘বুলবুলের পরিবার চাচ্ছিলেন ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন তদন্তের স্বার্থে এখন দেখা করা যাবে না। আমরা তাদেরকে আশ্বাস দিয়েছি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমরা চাই এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং সুবিচার হোক।’
এদিকে বুলবুলের কক্ষে থাকা তার ব্যবহারের জিনিসপত্র পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন বলে জানান শাহপরাণ হলের প্রভোস্ট ড. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, সকালে বুলবুলের পরিবারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সে আমাদের হলের ২১৮ নং কক্ষে থাকতো। তার রুমের ব্যবহৃত ল্যাপটপ, বই-খাতা, লেপ, তোষক, বালিশসহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস পরিবারের সদস্যদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় শাবি ক্যাম্পাসের গাজী কালুর টিলায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বুলবুল নিহত হন বলে পুলিশ জানায়। বুলবুল হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ পর্যন্ত ৩ আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা সবাই আদালতে ১৬৪ ধরায় জবানবন্দি দিয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন