ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পারে চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে ২০ অক্টোবর ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০ অক্টোবর এই দিনে ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন' (২৮ নং আইন) বলে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সাফল্য ও গৌরবের ১৯ বছর পেরিয়ে ২০ বছরে পদার্পণ করেছে আজ।
প্রতিবছরের ন্যায় জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা, বর্ণিল আয়োজন ও আমেজের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়। এই দিনটিকে ঘিরে ক্যাম্পাসকে বর্ণিল রঙে সাজানো হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসবের আমেজে মেতে উঠে। এবারে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করা হচ্ছে দিবসটি।
তবে এই বছরে ক্যাম্পাসে কোনো আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সকল নিহত-আহতদের স্মরণ করে নতুন থিমে পালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ তম দিবস। এবার ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য খাবারের আয়োজনের পাশাপাশি ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করেছে প্রশাসন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাম ফলক পুনরায় স্থাপন করা হবে দিবসের দিন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন 'জগন্নাথ কলেজ' থেকে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়। অনেক সংগ্রাম ও সাফল্যের মাধ্যমে আজকের এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৮৭২ সালে বলিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তাঁর বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজ ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে রূপ নেয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পুরান ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারীকরণ করা হয় কিন্তু পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারি মর্যাদা লাভ করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। ছাত্ররা অনেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গণহত্যা চালানো হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শহীদ হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প করা হয়। যুদ্ধ শেষে এখানে গণকবরের সন্ধান মেলে; উদ্ধার করা হয় কয়েক ট্রাক ভর্তি মানব কঙ্কাল। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয় এলাকার প্রভাবশালীদের জগন্নাথ কলেজের হল দখলের পাঁয়তারা। ছাত্রদের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ বাধে বারবার। প্রথমে বেদখল হয়ে যায় কুমারটুলি ছাত্রাবাস। এরপর একের পর এক বেদখল হয় ৮৪ জিএল পার্থ লেন, কুমারটুলিতে (ওয়াইজঘাট স্টার সিনেমা হলের পিছনে) অবস্থিত হলগুলো। ১৯৯২ সালে ১৪টি ছাত্রাবাসের মাত্র ৩টি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাকিগুলো পুলিশ ও এলাকাবাসীরা দখল করে নেয়। ৩টি ছাত্রাবাসের দুটি (মাহমুদা স্মৃতি ভবন ও এরশাদ হল) বর্তমানে ভেঙ্গে মসজিদ ও কলা অনুষদ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী সকল আন্দোলন, সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই প্রতিষ্ঠানটি কলেজ আমল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাস আঙ্গিনায় ইতিমধ্যে সুনাম ছড়িয়েছে সারাদেশে। বিসিএস, ব্যাংক, বিমা, জুডিশিয়ারি, আইনজীবী, এসআই, সার্জেন্ট, কর্পোরেট, মাল্টিন্যাশনাল সহ সকল স্তরে ভালো করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেরই বলিষ্ঠ উপস্থিতি এই আন্দোলনে গতিসঞ্চার করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ এবং গণিত বিভাগের আহসান হাবিব তামিম এই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন। স্বৈরাচারের দোসর ও পুলিশের আক্রমণে আহত হয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১.১১ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে সাড়ে ৭ একর জায়গায় রয়েছে। যার মধ্যে একটি প্রশাসনিক ভবন, কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান ভবনসহ মোট নয়টু টি ভবন রয়েছে। একটি শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক গুচ্ছ ভাস্কর্য 'একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি' বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে ৪ টি অনুষদ, ২২ টি বিভাগে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৮টি অনুষদ, ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট। এছাড়াও নতুন তিনটি বিভাগ এবং একটি অনুষদ চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৭ হাজার ছয়শত ২৩ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যায়নরত আছে। প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ৬৮০ জন শিক্ষক রয়েছে। এছাড়াও ২৩৮ জন কর্মকর্তা ও ৩৩৩ জন কর্মচারী, ১৭৫ জন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং ২০৪ জন বিভিন্ন পেশায় দৈনিক হাজিরাভিত্তিক হিসেবে নিয়োজিত আছে।
প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠটির প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নতুন ৭ তলা ভবনের ৬ তলায় অবস্থিত একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এবং ভিন্ন ভিন্ন দুইটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার রয়েছে। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা ৩১ হাজার ৩২৬ টি। গ্রন্থাগারে ইন্টারনেট সুবিধাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বইয়ের সমাহার বিস্তৃত। বর্তমানে ছাত্রীদের আবাসিক সমস্যা নিরসনে 'বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব' নামের একটি ১৬ তলা বিশিষ্ট এক হাজার ২০০ আসনের একটি হল রয়েছে।
এছাড়া অনাবাসিক খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত যাতায়াতে নিজস্ব সিলভার রঙের একতলা-দ্বিতলা বাস, মাইক্রোবাস, বিআরটিসির ভাড়া কৃত লাল রঙের দ্বিতলা বাস সহ সর্বমোট ৫৭ টি বাস রয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মিলনায়তন, নিজস্ব একটি মেডিকেল সেন্টার, কাউন্সেলিং সেন্টার, শরীরচর্চা শিক্ষা কেন্দ্র, ডে-কেয়ার সেন্টার, যাক- তহবিল, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্য দুটি আলাদা আধুনিক কাফেটেরিয়া, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথকভাবে নামাজ পড়ার একটি দ্বি তলা বিশিষ্ট মসজিদ সহ মিডিয়া, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক ২০ টির অধিক সংগঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে ছোট্ট এই ক্যাম্পাসটিতে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের হল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অনাবাসিক সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কেরানীগঞ্জের তেঘুরিয়ায় নতুন ক্যাম্পাসের স্থাপন প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০০ একর জমির উপরে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক মানসম্মত এই ক্যাম্পাস। প্রকল্পটির মেয়াদ কাল শেষ হওয়ার কথা ৩০ অক্টোবর ২০২৪ সাল নাগাদ। যদিও ইতিমধ্যে নতুন ক্যাম্পাসের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার ফর এক্সিলেন্স করতে চাই। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ালেখা করবে, গবেষণা করবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে নিজেদের মেলে ধরবে।
তিনি আরও বলেন, আবাসন সংকট রয়েছে আমরা সবাই জানি। আমরা চেষ্টা করছি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ আগামী মাসের মধ্যে চালু করতে। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা নতুন করে নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন ইনশাআল্লাহ আমরা সুন্দর একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দেব।
বিডি প্রতিদিন/মুসা