পুলিশী হয়রানি বন্ধ ও নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত আগস্টে মিরপুর বিভাগ পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলেন চায়ের দোকানদার বাবুল মাতব্বর। কিন্তু ৬ মাস পার না হতেই নিরাপত্তার বদলে পুলিশ ও সোর্সের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হলো বাবুলকে। বলা হচ্ছে পুলিশকে চাঁদা না দেওয়ায় এই খুন, তবে স্বজনদের কেউ কেউ বলছেন, মাদক ব্যবসা ছেড়ে চায়ের দোকান দেওয়ায় জীবন দিতে হয়েছে বাবুলকে। কারণ, তিনি এই মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা অনেক রথি-মহারথিকে চিনতেন। তারা বাবুলকে নিজেদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছিলেন।
সূত্রে জানা গেছে, শাহ আলী থানা এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী পারুলের মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বাবুল মাতুব্বর। দীর্ঘদিন মাদকের স্পটে জড়িত থাকাকালীন বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। মাস ছয়েক আগে থেকে মিরপুরের ডিসিকে লিখিত মুচলেকা দিয়ে মাদক ছেড়ে চায়ের দোকান দেন বাবুল। শাহ আলী থানাধীন গুদারাঘাট সংলগ্ন কাজীফুরি কিংশুক সিটির পাশেই ছিল বাবুলের চায়ের দোকান। সেখানেই গত বুধবার রাতে পুলিশ আর সোর্সের দেওয়া আগুনে পুড়ে ঝলসে যান বাবুল।
এদিকে বাবুলের অগ্নিদগ্ধের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, দ্রুত হাসপাতালে নিলে বাবুল হয়ত বেঁচেও যেতে পারতেন। কিন্তু বুধবার রাতে দগ্ধ হওয়ার পর পুলিশ বাবুলকে হাসপাতালের বদলে থানায় নিয়ে যায়। থানা থেকে পরে পরিবারের সদস্যরাই দগ্ধ বাবুলকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এটা বাবুলের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য করা হয়েছিল বলে অভিযোগ স্বজনদের।
নিহত বাবুল মাতুব্বরের পরিবারের অভিযোগ, গত বুধবার রাতে গুদারাঘাট এলাকায় চাঁদা না পেয়ে পুলিশ বাবুলের দোকানের কেরোসিনের চুলায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এতে কেরোসিন ছিটকে বাবুলের গায়ে আগুন ধরে যায়। দগ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে মারা যান। বাবুল দগ্ধ হওয়ার দিনগত রাত দেড়টার দিকে অনেকটা তড়িঘড়ি করে মেয়ে রোকসানা আক্তারকে দিয়ে শাহ আলী থানার ওসি একেএম শাহিন মণ্ডল একটি মামলা করান। মামলায় কোনো পুলিশ সদস্যকে আসামি না করে স্থানীয় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে পারুল নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নিহতের মেয়ে রোকসানা আক্তার জানান, ''বাবা আগে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পৌনে এক বছর আগে ওই পেশা ছেড়ে চায়ের দোকান দেয়। কিন্তু পুলিশ বাবাকে হয়রানি করতে থাকে। এরপর গত বছরের ১৬ আগস্ট আবারো ডিসি বরাবর পুলিশী হয়রানি বন্ধ ও স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন। পুলিশের উপর বিশ্বাস ছিল তাই বাবা ডিসিকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো এভাবে বাবাকে পুলিশ পুড়িয়ে মারবে।''
বাবুলের স্বাক্ষর করা সেই আবেদনের কপিতে উল্লেখ করা হয়, ''আমি বাবুল মাতব্বর ইলেক্ট্রনিক্সের কাজসহ যখন যে কাজ পাই সে কাজ করেই কোনো রকম পরিবার নিয়ে দিন যাপন করছি। আমি কোনো মাদক খাইও না এবং বিক্রয়ও করি না। লোক মারফত শুনতে পাই, আশেপাশের ঘরের লোকজন নাকি মাদক বিক্রয় করে। উক্ত ঘরে মাদক বিক্রেতাদের খুঁজতে এসে পুলিশ আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে।''
আবেদনের শেষে লেখা ছিল, ''পুলিশ আবারো হয়রানি শুরু করেছে। ফলে আমি সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকি। থানা পুলিশ অন্য কাউকে খুঁজতে গিয়ে যেন আমাকে হয়রানি না করে এজন্য শাহ আলী থানাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান এবং আমাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগ দানে আপনার মর্জি হয়।''
কিংশুক এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাবুল পারুলের মাদক স্পটের কাজ ছেড়ে দিলেও পারুল বাবুলকে ছাড়েনি। সে বাবুলকে মাদক ব্যবসায় ফেরাতে না পেরে পুলিশকে দিয়েই তাকে পুড়িয়ে মেরেছে। আর পুলিশের একটা অসাধু চক্র এর সঙ্গে জড়িত।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলমান ভাবমূর্তিতে ভীষণ বিব্রত পুলিশ। আর সে কারণে কঠিন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ডিএমপি। এরই অংশ হিসেবে ডিএমপি বৃহস্পতিবারই বরখাস্ত করেছে শাহ আলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান, এসআই নিয়াজউদ্দিন মোল্লা, এএসআই জোগেন্দ্রনাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে। এরপর শুক্রবার বিকেলে প্রাথমিক তদন্তে থানার ওসির গাফিলতির প্রমাণ পেয়ে তাকেও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলী থানার এসআই মুক্তারুজ্জামান বলেন, গতকাল পারুলকে আদালতে পাঠিয়ে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার অন্য পাঁচ আসামিকে গ্রেফতারে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।
বিডি-প্রতিদিন/০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/ এস আহমেদ