তরুণটির লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো। হাত বাঁধা। বিছানায় পড়ে আছে তরুণীর লাশ। কী হতে পারে ভাবছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তরুণটি আত্মহত্যা করেছে বলেই প্রতিবেদন এসেছে। আর তরুণীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার আগে তার সঙ্গে যৌন-সংসর্গ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি ডিএনএ টেস্টেও তরুণীর শরীরে শুধু সেই তরুণের ডিএনএ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ রয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, তরুণীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর সেই তরুণটি আত্মহত্যা করেছে। মামলার তদন্তও এখানেই শেষ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তার মনে নানা প্রশ্ন। আত্মহত্যা করলে তরুণটির হাত বাঁধল কে? এমন নানা প্রশ্নের জবাব ছাড়া কাগজে-কলমে মামলার তদন্ত শেষ হলেও গোয়েন্দা কর্মকর্তার তদন্ত যেন শেষ হচ্ছে না। নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই তদন্ত চালিয়ে যাওয়া। একসময় সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তার তদন্তই সঠিক প্রমাণিত হয়। ওই কক্ষে পড়ে থাকা তিন ব্র্যান্ডের সিগারেটের ফিল্টারই ঘটনার রহস্য উন্মেচিত হতে সাহায্য করে। খুঁজে পাওয়া যায় খুনিদের। প্রমাণিত হয়, তরুণ-তরুণী দুজনই হত্যার শিকার। আসামিরাও ধরা পড়েন।
ঘটনাটি রাজশাহীর। গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর হোটেল নাইসের ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে মিজানুর রহমান এবং তার বান্ধবী পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মিজানুরের লাশ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো ছিল। আর সুমাইয়ার লাশ ছিল বিছানায়। মিজানের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ঘটনার পর রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় হত্যা মামলা হয়। মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। দুই পরিবার তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে খুন রহস্য। ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আরেকজনকে খুঁজছে পিবিআই। প্রথমে থানা-পুলিশ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছিল, সুমাইয়াকে মাথায় আঘাত করেছিলেন মিজান। এরপর বালিশচাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী পিবিআইর উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম। গত বছর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেও পরিদর্শন করেছিলেন ঘটনাস্থল। তার কাছে এটি ক্লুলেস খুন বলেই মনে হয়েছে। তবে কিছু বিষয় তার কাছে খটকা লেগেছিল প্রথম থেকেই। যেহেতু মামলার তদন্ত থানা পুলিশ করছিল, তাই এক্ষেত্রে তার কিছু করার ছিল না। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে কয়েকটি বিষয় খটকা লাগে এই কর্মকর্তার। হোটেল রুমে তিন ‘ব্র্যান্ডের’ সিগারেটের ফিল্টার পড়েছিল। তা ছাড়া ছেলেটার লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো থাকলেও তার দুই হাত ওড়না দিয়ে বাঁধা ছিল। তার প্যান্টটি কোমর থেকে ভাঁজের মতো করে নিচে নামানো ছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল কেউ একজন টান দিয়ে নামিয়েছে। তা ছাড়া মিজানের গলার দুই পাশে দাগ ছিল। আত্মহত্যা করলে সেই দাগ একদিকে হওয়ার কথা। এসব চিহ্ন দেখে তখনই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। কক্ষে পাওয়া তিন ধরনের সিগারেটের ফিল্টার তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়। একজন মানুষ একই সঙ্গে তিন ধরনের সিগারেট খেতে পারে না। এখানে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার চার তরুণ হলেন— রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের প্রাণিবিদ্যা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর ওরফে উৎস (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০) ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০)। আহসান ও বোরহান ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই বন্ধু। নিহত মিজানও ছিলেন তাদের পরিচিত। আহসানের বাড়ি পাবনার ফরিদপুরের জন্তীহার গ্রামে, রাহাতের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়, আল আমিনের বাড়ি রাজশাহীর পবায় আর বোরহানের বাড়ি লালপুরের নাটোরে। পিবিআই কর্মকর্তারা ১৮ অক্টোবর আহসান হাবিবকে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করেন। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সুমাইয়ার সঙ্গে রাহাতের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মিজানের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন রাহাত। এরপরই পরিকল্পিতভাবে হোটেলে কক্ষে গিয়ে দুজনকে হত্যা করা হয়। সব শেষে পুরো ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য মিজানের লাশটি ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন আহসানকে ফোন দেন মিজান। তার ভাই ও ভাবী রাজশাহী আসছেন এবং তাদের থাকার জন্য ভালো আবাসিক হোটেলের সন্ধান চান তিনি। কিন্তু আহসান জানতে পারেন ভাই-ভাবী নয়, সুমাইয়া রাজশাহী আসছেন। এরপর বিষয়টি তিনি রাহাতকে জানান। আহসানের কাছে এমন কথা শুনে মাথায় খুন চাপে তার। সুমাইয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সুমাইয়া এখন আরেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে, এটি মেনে নিতে পারছেন না রাহাত। অপেক্ষায় থাকেন সুমাইয়াকে ধরতে। সেদিনই রাহাত দেখতে পান সুমাইয়াকে। সঙ্গে মিজান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তারা ঘোরাফেরা করছেন। রাহাত এ সময় আহসান, আল আমিন আর বোরহানকে বলেন সুমাইয়া এবং মিজানকে অনুসরণ করতে। মিজান ও সুমাইয়া একটি অটোতে ওঠেন। আরেকটি অটোতে করে চারজন তাদের অনুসরণ করেন। সুমাইয়া ও মিজান নাইস হোটেলের সামনে থামেন। তারাও সেখানে নামেন। রাহাত ও আহসান মিলে হোটেলের এক বয়কে হাত করেন। এরপর তারা চারজন নাইস হোটেলের পাশের তিনতলা একটি মার্কেটের ছাদে ওঠেন। সেখান থেকে হোটেল বয়ের সাহায্যে জানালা দিয়ে ৩০৩ নম্বর কক্ষে ঢোকেন। কক্ষে তখন শুধু সুমাইয়া ছিলেন। মিজান তখন একটু রুমের বাইরে ছিলেন। সুমাইয়ার সঙ্গে রাহাত ও আহসানের বাগিবতণ্ডা হয়। মিজানকে ফোন করে ডেকে আনার জন্য সুমাইয়াকে বলেন। সুমাইয়ার ফোন পেয়েই মিজান কক্ষে আসেন। মিজানকে তারা বেধড়ক পেটান। একপর্যায়ে কেউ একজন হোটেলের টি টেবিল ভেঙে তার পায়া দিয়ে মিজানের মাথায় আঘাত করলে তিনি পড়ে যান। এরপর সুমাইয়ার একটি ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলা হয়। আরেকটি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া তরুণদের তথ্যমতে, মিজানের লাশ কক্ষের মেঝেতে রেখেই সুমাইয়াকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তারা। এরপর বালিশচাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। দুজনকে হত্যার পর তারা মিলিতভাবে মিজানের লাশ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। এরপর তারা আবার জানালা দিয়েই পাশের মার্কেটের ছাদ হয়ে বেরিয়ে যান। ঘটনার পর কাউকে কিছু না বলতে রাহাত আহসানকে পাঁচ হাজার টাকা আর আল আমিনকে ১০ হাজার টাকা দেন। পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার ভার পিবিআইকে দিলে তদন্ত শুরু করে। থানা-পুলিশ মামলাটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি বলে তার মনে হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মিজানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা এবং ডিএনএ পরীক্ষায় শুধু মিজানের ডিএনএ উপস্থিত থাকার বিষয়টি আসায় পুলিশ হত্যাকাণ্ডের যথেষ্ট আলামত থাকা সত্ত্বেও আর খতিয়ে দেখেনি। পিবিআই সূত্র জানায়, তদন্ত শুরুর পর তারা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সুমাইয়া ও মিজানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথোপকথনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন। সেখান থেকে তারা আহসানকে শনাক্ত করেন। তারপর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকিদের শনাক্ত করা হয়। তিনি বলেন, থানা-পুলিশ যদি আরও দায়িত্বশীল হতো তাহলে প্রথমেই এই মামলা শনাক্ত করা সম্ভব ছিল। এত দিন অপেক্ষা করতে হতো না।
বিডি-প্রতিদিন/২৮ অক্টোবর, ২০১৭/মাহবুব