রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে শিল্পীর স্বরূপ ও কর্মকাণ্ড ভিন্নতর হতে পারে। তবে শিল্পের নান্দনিকতা ও আবেদন সীমাহীন ও চিরন্তন। শিল্পী তার নিজস্ব চেতনা, পারিপার্শ্বিকতা তথা স্থান-কাল পাত্রকে ধারণ করে তা ফুটিয়ে তোলেন তার শিল্পকর্মে। তাই প্রতিটি শিল্পকর্মে শিল্পীর চিন্তা-চেতনার পাশাপাশি জাতীয় সংস্কৃতি ও নিজস্ব কৃষ্টি ফুটে ওঠে। তাই শিল্পকর্ম ও শৈল্পিক ভাবনা ব্যক্তিশিল্পীর হলেও তার সৃষ্টিশীল কর্মের ব্যাপ্তি সর্বত্র এবং তা সর্বজনীন। গতকাল বিকালে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে তিনি এসব বলেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এই চিত্রকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিটও উন্মোচন করেন। পরে রাষ্ট্রপতি তিনজনকে গ্র্যান্ড পুরস্কার এবং ছয়জন শিল্পীর হাতে সম্মানসূচক পুরস্কার তুলে দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং সম্মানিত অতিথি ছিলেন এবারের প্রদর্শনীর পর্যবেক্ষক জাপানি ইমেরিটাস প্রফেসর তেতসুইয়া নোদা। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন বিচারকমণ্ডলীর প্রধান শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। সংস্কৃতি সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন দেশ-বিদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী, জুরি, শিল্প-সমালোচক, পর্যবেক্ষক, কিউরেটর এবং অতিথিরা।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন কেবলমাত্র এশীয় দেশগুলোর অংশগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি এ আয়োজনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের আয়োজনে বিশ্বের ৬৮টি দেশের অংশগ্রহণ সত্যিই প্রশংসনীয়। এই প্রদর্শনী আজ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও খ্যাতনামা চারুকলা প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে।
দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ভাষার জন্য আত্মদানের মহিমায় বাঙালি জাতি বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও সমাদৃত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।রাষ্ট্রপতি বলেন, আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের পথ ধরে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এ দেশের শিল্পীসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দেশের শিল্পী সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জাতির যে কোনো প্রয়োজনে বা সংকটময় মুহূর্তে সংস্কৃতিকর্মীরা সবসময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণেও শিল্প-সংস্কৃতি অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। একটি জাতির তরুণ ও যুবসমাজের মাঝে শৃঙ্খলা, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেমের চেতনা বিকাশসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য জাগিয়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে মৈত্রীর বন্ধন ও সম্পর্কের উন্নয়নে শিল্পকলার অবদান ব্যাপক। শিল্পকলা একটি দেশ ও জাতিকে বিশ্ব মানচিত্রে গৌরব ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী দেশ-বিদেশের শিল্পীদের মধ্যে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক শক্তিশালী ও কার্যকর প্লাটফর্ম। এ আয়োজন চারুশিল্পের নান্দনিকতায় যোগ করবে নতুন মাত্রা। প্রদর্শনীর শিল্পনৈপুণ্য আগত শিল্পী ও দর্শকদের যেমন উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে তেমনি উন্মেষ ঘটাবে বর্ণাঢ্য শিল্পসত্তার।
এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী আতিয়া ইসলাম, সালমা জাকির বৃষ্টি ও ভারতের শিল্পী কানড্যাং। সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন, ফকরুল ইসলাম মজুমদার, নাজমুন নাহার কেয়া, চীনের শিল্পী উ জুন, ফিলিস্তিনের শিল্পী মোনতাহের জাওয়াব্রে ও থাইল্যান্ডের ত্রিরাত স্রিবুরিন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতীয় চিত্রশালায় প্রদর্শনীর নানা শিল্পকর্ম ঘুরে দেখেন।
স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৬৮টি দেশের শিল্পীদের ৩৬৮টি পেইন্টিং, প্রিন্ট ও ফটোগ্রাফি, ৩৩টি ভাস্কর্য, ৫২টি ইলাস্ট্রেশন আর্ট নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রদর্শনী। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চিত্রশালা প্লাজার ছয়টি গ্যালারিতে শিল্পানুরাগীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এই প্রদর্শনী। ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হবে মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী।