রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মোহাম্মদপুর হাউজিংয়ে তিন প্রজন্মের পর এখন ২৮৮ পরিবার বাস্তুহারা

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি

হাসান ইমন

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) আওতাধীন মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের নূরজাহান রোড ও কাজী নজরুল ইসলাম রোডের পাশে ১৯৬০ সালের দিকে স্থাপিত হয় ৮টি ডি-টাইপ কলোনি। প্রতি ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৩৬টি। ২০০ বর্গফুটের এসব ফ্ল্যাটে বৈধভাবে বসবাস করে আসছে বরাদ্দপ্রাপ্ত ২৮৮টি পরিবার। তবে সম্প্রতি আলোচনা ছাড়াই এসব ভবন উচ্ছেদ করেছে জাগৃক। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। তবু অনেকটা খামখেয়ালিতেই এসব ভবনের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে সংস্থাটি। এ পরিস্থিতিতে স্থায়ী ঠিকানা হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারগুলো। তিন প্রজন্ম বসবাস করা মানুষগুলো এখন বাস্তুহারা। কলোনির ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অভিযোগ, কলোনির ৮টি ভবনে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে বৈধভাবে ২৮৮টি নিম্ন আয়ের পরিবার বসবাস করছে। তবে সম্প্রতি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কনকচাঁপা ও দোলনচাঁপা নামে ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা শুরু করে। বরাদ্দ দেওয়ার সময়ের শর্ত অনুযায়ী এখানকার নিম্ন আয়ের মানুষ ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ৩০ বছরে এ হাউজিং প্রকল্পের সুদসহ জমির দাম ও নির্মাণ ব্যয় মাসিক ভাড়া প্রদানের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। এরপর ৩০ বছর ধরে ব্যবস্থাপনা ও মেরামত গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের করার কথা থাকলেও বাসিন্দারাই করে আসছেন। সেখানে আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করে ন্যূনতম আলোচনা ছাড়া একতরফাভাবে একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অতি উচ্চমূল্যে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে নিতে অন্য আবেদনকারীদের সঙ্গে টাকা জমা দিয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই দুই প্রকল্পে ২৮৮ পরিবার ছাড়াও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের জন্য যে ফ্ল্যাট মূল্য ধরা হয়েছে, একই দরে মোহাম্মদপুর হাউজিংয়ের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকেও ধরা হয়েছে। সরকারি আমলাদের এই অর্থ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে, আমাদের তো নেই। কর্তৃপক্ষ আগে বলেছিল, ক্ষতিগ্রস্তদের জমির দাম দিতে হবে না। সে হিসাবে আমাদের ওপর দর চলে আসে অর্ধেকে। কিন্তু এখন দেখছি সবার সমান অর্থ দিতে হবে। তাহলে আমরা প্রথম ৩০ বছর কেন ৫% সুদহারে কিস্তি দিলাম?

কলোনির বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই স্থায়ী ঠিকানা ছাড়া তাদের অন্য কোনো আবাস নেই। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও নেই পরিবারে। সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে উচ্ছেদ করলে তারা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হবেন।

ভুক্তভোগীদের একজন আনোয়ার কামাল। তিনি বলেন, ষাটের দশকে মোহাম্মদপুর ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ পশ্চাৎপদ এলাকা। আমরা বরাদ্দ পাওয়ার পর এ এলাকা বাসযোগ্য করেছি। এরপর নিয়মিত টাকা পরিশোধ করেছি। নিয়ম অনুসারে এখন এ কলোনি আমাদের। কিন্তু গৃহায়ণের কিছু লোভী কর্মকর্তার নজরের কারণে সব হারানোর শঙ্কায় আমরা। তিনি আরও বলেন, আমরা আদালতের আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। আমরা দাবি করছি, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে কিছুদিন সময় দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ নেবে। এই ভোক্তভোগী আরও বলেন, এখানে ১২০০-১৩০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে চায় জাগৃক। কিন্তু এত বড় স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনতে অনেকের সামর্থ্য নেই। আমরা বলেছি, ৬০০-৭০০ স্কয়ার ফিটের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা করেন।

কারণ এখানে যারা থাকেন, তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারা আমাদের কথা  শোনেননি। ডি-টাইপ কলোনি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মিজানুর রহমান তালুকদার বলেন, হঠাৎ করে উচ্ছেদের উদ্যোগ নিচ্ছে। আমরা মানববন্ধন করেছি। দাবি জানিয়েছি, কোনোরকম আলোচনা ছাড়া, আমাদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি ছাড়া এ ধরনের কাজ তারা করতে পারে না। কারণ বরাদ্দের নিয়ম অনুসারে ভবন ও জমির দাম আমরা পরিশোধ করেছি; কিন্তু এখন কিছু বড় কর্মকর্তার চোখ পড়েছে এ জমির ওপর। তারা এখানে ফ্ল্যাট নিতে চায়। তিনি বলেন, বর্তমান এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী যেখানে গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছেন, আর সেখানে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ আমাদের উচ্ছেদ করেছে। অথচ ১৯৬০ সালে জাতিসংঘ একটি সংস্থার মাধ্যমে আমাদের দিয়েছে। আমরা ৬২ বছর এখানে অতিবাহিত করেছি। এখন আমরা বাস্তুহারা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে গত বুধবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কার্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির সচিব মোহাম্মদ উল্ল্যাহকেও দফতরে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই সঙ্গে ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা উইং সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন মোল্লাকেও পাওয়া যায়নি। পরে তাকে ফোন দিলে এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর