সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

হালদার উজানে তামাকের বিষ

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

হালদার উজানে তামাকের বিষ

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর উৎস এলাকায় দুই বছর আগেও ছিল না তামাক চাষ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তামাক চাষ চলে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। আশপাশের জমিগুলোতে করা হতো সবজি চাষ। কিন্তু গত বছর থেকে হালদার উজানে ফের শুরু হয়েছে তামাক চাষ। তামাক চাষে কোম্পানির লোভনীয় অফারে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে কৃষক। এতে বাড়ছে চাষ। তামাকবর্জ্য ও কীটনাশকের পানি সরাসরি পড়ছে হালদা নদীতে। ফলে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হালদার মৎস্য প্রজনন। একই সঙ্গে কমছে জমির উর্বরতা, কমছে সবজি চাষ, নষ্ট হচ্ছে পানির ধারণক্ষমতা, ক্ষয় হচ্ছে মাটি, রাসায়নিকের প্রভাবে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য, পানি, জলজপ্রাণি, পরিবেশসহ আরও অনেক কিছু। প্রসঙ্গত, তামাক গাছের উচ্ছিষ্ট পচা পাতা, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ধোয়া পানি বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে গিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে তামাক গাছের মূলও নদীতে এসে পড়ে। তাছাড়া তীরে চুল্লিতে তামাক পাতা পোড়ানোর কারণে উচ্ছিষ্ট অংশও নদীতে গিয়ে পড়ে। তামাকের বিষ ছড়িয়ে পড়ে নদীতে। হালদার মৎস্য প্রজননে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অভিযোগ আছে, কিছু ট্যোবাকো কোম্পানি চাষিদের অর্থের প্রলোভন এবং স্থানীয় মহাজনদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এদের মাধ্যমে কৃষকদের তামাক চাষে প্রলুব্ধ করছে। তামাক কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় অসহায় আদিবাসী ও বাঙালি কৃষকদের মাঝে ঋণের সহজলভ্যতা, সার, বীজ, কীটনাশক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও নিজেদের বাজার ব্যবস্থাপনা করে দেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে নগদ ১০ হাজার টাকা করে। যা পাতা সংগ্রহকালীন কেটে নেওয়ার শর্ত রয়েছে টোবাকো কোম্পানি সঙ্গে। জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে ‘হালদা নদীর উৎপাদনশীতা বৃদ্ধি ও হালদা উৎসের পোনার বাজার সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের  (পিকেএসএফ) অর্থায়ন ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) উদ্যোগে এবং মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উজান এলাকার জমিগুলোতে সবজি চাষ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ২০২০ সালের দিকে হালদার উজান মানিকছড়ি অংশে তামাকের চাষাবাদ শূন্যের কোটায় নেমে আসে। কিন্তু গত মৌসুমে ফের শুরু হয় তামাক চাষ। গত নভেম্বর থেকে মানিকছড়ি এলাকার বড় একটি অংশের চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে টোবাকো কোম্পানি। চলতি মৌসুমে ঘোরখানা, আসাদতলী, কালাপানি, তুলাবিল, ছদুরখীল এলাকায় ৩৫ হেক্টর জমিতে ৩৪ জন কৃষক নতুনভাবে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়েন।   চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ২০১৭ সালে মানিকছড়িতে তামাক চাষ বন্ধে কাজ শুরু করা হয়। ২০২১ সালে প্রায় ৯৯ শতাংশ তামাক চাষিকে মূলধারার কৃষি কাজে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে আবারও মানিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে তামাক চাষ শুরু হয়। এটি বড় ধাক্কা। কারণ হালদা নিয়ে যতই পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা হোক না কেন উজান এলাকায় তামাক চাষ বন্ধ করা না গেলে প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার জন্য আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন, নদীটিকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং যে কোনো মূল্যে হালদাকে রক্ষা করতে হবে। আর হালদা রক্ষার জন্য তামাক চাষ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে গেজেট পরিবর্তনের মাধ্যমে হালদার অববাহিকায় তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। আইডিএফের হালদা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, তামাক চাষে ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক ও কীটনাশক। ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানি ধারণক্ষমতা নষ্ট, মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। তার হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও জলজপ্রাণি এবং মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ।

 বিশেষত, মাছ ডিম পাড়ার সময় তামাকের কীটনাশক পানির সঙ্গে মেশার কারণে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তামাকের কারণে অসুস্থ হচ্ছেন চাষিরা। পাতা শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বনাঞ্চলের কাটা, ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। 

মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রক্তিম চৌধুরী বলেন, স্থানীয় চাষিরা যাতে তামাক চাষ না করে অর্থকরী ফসল চাষ করেন, সে জন্য সরকারিভাবে তাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত প্রচারণা অনুষ্ঠানও করা হয়।  

মানিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসিবুর রহমান বলেন, এ বছর নতুন করে আবারও তামাক চাষ হচ্ছে। এর ফলে কমছে জমির উর্বরতা, নষ্ট হচ্ছে সুস্থ পরিবেশ, চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের কাঠ। তামাক চাষে কৃষক ও দিনমজুররা তামাক পাতা নাড়াচাড়া করার কারণে স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তবে তামাক চাষ কমাতে আমরা নানা ধরনের অর্থকরী ফসল ধান, গম, ভুট্টা ও সবজি চাষে উৎসাহ দিচ্ছি। ফসল উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রণোদনা। 

তামাকের ক্ষত দেহে : মানিকছড়ি উপজেলার আসাদতলী এলাকার কামাল উদ্দিন। গত বছর তিনি তামাক চাষ শুরু করেন। কিন্তু চাষ করার কিছু দিনের মধ্যেই তার পায়ে ক্ষত দেখা দেয়। দেখতে দেখতে পায়ের ক্ষত বেড়ে যায়। পুরো দুটি পা-ই দগদগে হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। এভাবে কেবল কামাল উদ্দিন নয়। তামাক চাষে জড়িত অনেকের শরীরেই নানাভাবে ক্ষত তৈরি হয়। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও শরীরের অন্য অংশে। তাছাড়া, তামাক চাষের কারণে চাষিদের মধ্যে বাড়ছে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা, বমিসহ নানা সমস্যা।   

পুড়ছে কাঠ : এক একর জমির তামাকের পাতা চুল্লিতে শুকাতে ৭২ ঘণ্টায় প্রয়োজন হয় ৬ টন কাঠ। এসব কাঠ আশপাশের বন থেকেই সংগ্রহ করা হয়। ফলে পুড়ছে কাঠ, উজাড় হচ্ছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। ঘোরখানা, আসাদতলী, কালাপানি, তুলাবিল, ছদুরখীল এলাকায় ৩৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা তামাক পাতা এভাবে বনের কাঠ দিয়ে পোড়া হচ্ছে। এভাবে কাঠ পুড়তে থাকলে আগামীতে বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর