দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে চরম সংকটে রয়েছে দেশের বিমা খাত। গত ১৫ বছরে দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেছে। তার পরও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের বিমা খাতের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব নেই। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে বিমা খাতে তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। ওই বছর মোট ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে বিমা কোম্পানিগুলো পরিশোধ করেছে মাত্র ৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
২০২৩ সালে দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৬১ দশমিক ১৬ শতাংশ। অথচ বৈশ্বিকভাবে এই হার ৯৭-৯৮ শতাংশের মধ্যে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল প্রায় ৯৮ শতাংশ। বাংলাদেশে বিমা গ্রহণের হারও অত্যন্ত নিম্ন, মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, যা বিশ্বের সবচেয়ে কম। তুলনামূলকভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে এ হার গড়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে ৩ দশমিক ২ এবং চীনে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবু ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিমা খাতের কোনো বড় ধরনের সংস্কার প্রস্তাব করেনি।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত সোমবার জাতীয় বাজেট উপস্থাপনকালে বলেন, গত ১৫ বছরের আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংস্কারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে বলা হলেও বিমা খাত নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা জানাননি।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকার আগের অর্থবছরের তুলনায় কম আকারের বাজেট ঘোষণা করেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রস্তাবিত আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বাজেটের তুলনায় শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ কম। দেশের বিমা খাতের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চলতি বছরের মার্চ মাসে আইডিআরএ ছয়টি সমস্যাগ্রস্ত জীবন বিমা কোম্পানিকে পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
গত ১৪ বছরে দেশে ২৬ লাখেরও বেশি বিমা পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে যেখানে সক্রিয় পলিসির সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ, সেখানে ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ লাখ ৮৮ হাজারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি আদিবা রহমান বলেন, বাজেট প্রণয়নের সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে একটি বৈঠকে কর ও ভ্যাট কমানোসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। এনবিআর ইতিবাচক সাড়া দিলেও বাজেটে কোনো দাবিই প্রতিফলিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, বিমা খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে আমাদের কোনো দাবি পূরণ হয়নি। কিছু কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, পুরো খাতের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ থাকা উচিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, ব্যাংক খাতে সংস্কারের কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিমা খাতে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাজেটেও এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, যা হতাশাজনক। তিনি আরও বলেন, যদি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাহলে সরকারের হাতে এখনো এক বছর সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে বিমা খাতে সংস্কার শুরু করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।