কুমিল্লার লাকসাম শহরে করোনার চরম ঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও স্থানীয় তিনজন রোগী অবাধ বিচরণের কারণে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।
সূত্র মতে, লাকসাম একটি প্রসিদ্ধ নগরী। এখানে গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত-অপরিকল্পিত আবাসন। লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট গ্রামীন জনপদসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে এ শহরে বসবাস করেন। লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজার ঐতিহাসিক ব্যবসা কেন্দ্র। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারী ও খুচরা ক্রেতারা এখানে এসে কেনাকাটা করেন।
দেশে করোনার প্রভাব শুরু হলে দৌলতগঞ্জ বাজারকে ঘিরে ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের যত দুশ্চিন্তা। এ বাজারে প্রতিদিন এতই জনসমাগম হয় যে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করা ছিল কঠিন কাজ। তারপরও দায়িত্বশীলদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনা সচেতনতায় সুফল আসতে থাকে। বাজারের হাসপাতাল, ফার্মেসী, মুদি দোকান, মাছ, মাংশ, কাচাবাজার ও ব্যাংক ছাড়া সকল দোকানপাট বন্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময়সূচি নির্ধারিত করে দেয়া হয়। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে দোকানের সামনে সুরক্ষারেখা আঁকা হয়। প্রশাসনের প্রতিদিনের তদারকির পরও জনসমাগম যখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছিল না, তখন বাজারের হাসপাতাল, ফার্মেসী ও ব্যাংক ছাড়া সকল দোকানপাট বন্ধ ঘোষণা করে বিকল্প ১৮টি বাজার চালু করা হয়। এসব পরিকল্পনায় জনসমাগম ঠেকাতে পারায় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগে স্বস্তি ফিরে আসে।
কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধানেই শহর এলাকায় তিনজন করোনা রোগী শনাক্তের সংবাদে সেই স্বস্তি বিষাদে রূপ নেয়।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার শহরের একটি মসজিদের অস্থায়ী মুয়াজ্জিনের করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসার সংবাদে শহর জুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। ভোলার ওই ব্যক্তি স্থানীয় একটি মসজিদে অস্থায়ী মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও মূলত তার পেশা ছিল ভিক্ষাবৃত্তি। তার শরীরে করোনার উপসর্গের সংবাদ পেয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের গঠিত ‘করোনা র্যাপিড রেসপন্স টিম’ তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে তাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দিলেও তিনি তা না মেনে কৌশলে বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ এবং কয়েকটি মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন।
নমুনা সংগ্রহের দুইদিন পর গত বৃহস্পতিবার তার রিপোর্ট পজেটিভ আসলেও তাৎক্ষণিক তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে প্রায় ৫ ঘণ্টা পর স্থানীয় একটি গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসলোশনে নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে আসছে।
এদিকে, শনিবার শহরের দক্ষিণ লাকসাম সাহাপাড়ার দুই সহোদরের করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসে। তারা দুই সহোদর একসঙ্গে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে একটি ফার্মে চাকুরি করতেন। ওই ফার্মের চাকুরিরত তাদের এক সহকর্মী করোনা আক্রান্ত হলে দুই সহোদরের মধ্যে একজন গত ১০/১১দিন আগে তথ্য গোপন করে লাকসামে এসে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন বলে জানা গেছে। ৬/৭দিন পর তাদের ওই সহকর্মী করোনায় মারা গেলে বুধবার রাতে অপর ভাইও চৌমুহনী থেকে লাকসামে চলে আসেন। এসময় পরিবারের লোকজন তাকে বাসায় প্রবেশ বাধা দিলে সে পার্শ্ববর্তী বাড়ি গিয়ে গোসল করে ওই পরিবারের সংস্পর্শে যান। পরবর্তীতে তিনি নিজ বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে যান।
খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের ও আশে-পাশের তিনটি বাড়ি লকডাউন ঘোষণা করে দুই সহোদরের নমুনা সংগ্রহ করে। শনিবার আইইডিসিআর থেকে প্রেরিত রিপোর্টে দুই সহোদরের করোনা পজেটিভ আসায় লাকসাম শহর জুড়ে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, তাদের অবাধ বিচরণে করোনার চরম ঝুঁকিতে রয়েছে শহর।
লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ‘করোনা র্যাপিড রেসপন্স টিম’ এর অন্যতম সদস্য ডা. আবদুল মতিন বলেন, মসজিদের মুয়াজ্জিন ও চৌমুহনী ফেরত দুই সহোদর যেখানেই ঘুরেছেন এবং যাদের সাথে মিশেছেন তাদের করোনা ঝুঁকি রয়েছে। আমরা তাদের সাথে কথা বলে সকল সম্ভাব্য সংস্পর্শে থাকাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর-এ পাঠাচ্ছি। ইতোমধ্যে এমন ১৩জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে অন্যদেরও খুঁজে বের করে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। রিপোর্ট এলে বলা যাবে তাদের সংস্পর্শে অন্য কেউ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা?
কুমিল্লা জেলার একমাত্র করোনা সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী বলেন, করোনায় আক্রান্তের পর রোগীরা যতটুকু জায়গায় চলাফেরা করেছেন এবং যাদের সংস্পর্শে গিয়েছেন তাদের জন্য এটা চরম ঝুঁকি। যারা গত কয়েকদিন বাজার এলাকায় গিয়েছেন তাদেরকে সকলকে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। দ্রুত বাজার এলাকায় জীবানুনাশক স্প্রে ছিটানোর পরামর্শ দেন। তিনি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেন।
লাকসাম পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক আবুল খায়ের বলেন, শহরের দক্ষিণ সাহাপাড়া মহল্লা পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছে। তাদের যে কোন সমস্যায় আমরা পাশে আছি। বাজার ও শহর এলাকা থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রায় প্রতিদিনই জীবনুনাশক স্পে ছিটানো হচ্ছে বলে তিনি জানান। একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাসা-বাড়ি থেকে বের না হতে নির্দেশনা দেন।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল