জাহাঙ্গীর আলম। বুকে ব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। দুই-তিন দিনেও সুস্থ না হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাৎক্ষণিক পরীক্ষার জন্য ছুঁটে যান সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পরীক্ষার নমুনা দিতে পারেননি। উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায় দুই ঘন্টা হাসপাতালের প্রধান কর্মকর্তাসহ একাধিক দপ্তরে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরে যান তিনি।
শুধু এই জাহাঙ্গীর আলমই নন, তার মতো অসংখ্য ব্যক্তিরা প্রতিদিন করোনা পরীক্ষার জন্য এসে ফিরে যাচ্ছেন। বগুড়ার শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিত্যদিনের চিত্র এটি। সরকারি হাসপাতালটিতে কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে বন্ধ রয়েছে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ। সাতদিন ধরে করোনা নমুনা সংগ্রহ বন্ধ থাকায় সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করায় আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই সরকারিভাবে ১৮ দফা নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতে করোনা নমুনা সংগ্রহ বন্ধ থাকার কারণে পরীক্ষায় পজিটিভ ব্যক্তিদের চিহিৃত করা যাচ্ছে না। ফলে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধিও। এমনকি করোনা আক্রান্তদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনা ঝুঁকি বাড়ছে।
অভিযোগে জানা যায়, বেশকিছুদিন ধরেই উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল কাদেরের সঙ্গে চিকিৎসক সাজিদ হাসান লিংকন ও ডা. আবু হাসানের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ চলে আসছে। পরবর্তীতে হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ওই বিরোধে জড়িয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধটি প্রকাশ্যে রুপ নেওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই দুই গ্রুপের রশি টানাটানিতে করোনা নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে।
দুই ভুক্তভোগী আলমাস ও শফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা। আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা ঘোরানো হয়। এরপরও নমুনা নেওয়া হয়নি। এমনকি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে করোনা পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্য উপদেশ দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খোদ হাসপাতালের দুইজন কর্মচারী বলেন, এই হাসপাতালে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই। কেউ কারো নির্দেশ মানেন না। বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জন অফিসকেও অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ রয়েছেন তারা। তাই নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই এখানে। ইচ্ছেমতো দায়িত্ব পালন করছেন ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না বলেও জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে হাসপাতালের দন্ত চিকিৎসক আবু হাসান বলেন, এই খাতে হাসপাতাল থেকে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেছি। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সংগ্রহ করা করোনার নমুনা বা স্যাম্পল বগুড়ায় ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার কর্মচারীকে টিএইচএ স্যার অন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই এসব নমুনা ল্যাবে পৌঁছানোর কোনো লোক নেই। ফলে প্রতিদিনই করোনা পরীক্ষার জন্য যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয় তা হাসপাতালেই জমা থেকে নষ্ট হচ্ছে। এজন্য আপাতত করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল কাদের বলেন, আমার জানা মতে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বন্ধ নেই। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ডা. আবু হাসান দায়িত্বে রয়েছেন। তাই কী কারণে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করছেন না সেটি তার কাছ থেকেই জানতে হবে। এছাড়া বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক রুপ নেওয়ায় সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিন এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ বন্ধের বিষয়ে জানা নেই। তবে জনবল সংকট ও বাজেট না থাকায় সপ্তাহের দুইদিন হাসপাতালটিতে এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল। তাই খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত