শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রাইস মিলের ধোঁয়া আর বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

রাইস মিলের ধোঁয়া আর বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ

ঘরবাড়ি গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কালি-ছাই আর ধুলায়। এলাকার সব জলাধার পচা পানি আর তুষ-ভুসিতে জমাট বাঁধা নর্দমায় পরিণত হয়েছে। প্রকৃতির বাতাসে ভরা বাণিজ্যের জঞ্জাল।  এমন অসহনীয় জনদুর্ভোগ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার বটতৈল-খাজানগর- পোড়াদহ এলাকায়। বছরের সব সময় সারাক্ষণই দূষিত বায়ু আর পানিতে বসবাস এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর। ফসলের মাঠেও দূষিত পানির বিড়ম্বনা। এ যেন দেখার কেউ নেই! ধান প্রক্রিয়াজাত করা, চাল, তুষ, ভুসি, আটা উৎপাদন করার কাজে এসব এলাকায় গত ৪৫ বছর ধরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪৫০টি কলকারখানা। এর মধ্যে বড় আকারের অটোমেটিক রাইসমিলই আছে ৫৫টি। যার অধিকাংশই মানছে না পরিবেশ সংরক্ষণ, শ্রমিক নিরাপত্তার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। ভারী এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটিরও নেই বর্জ্য শোধনাগার। মিলের দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ছেড়ে  দেওয়া হচ্ছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের খালে। যা চলে যাচ্ছে কৃষি জমিতে, এমনকি মাছ চাষের পুকুর-জলাশয়েও।

ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, মরে ভেসে উঠছে মাছ। দূষিত পানির সঙ্গে ধানের চিটা, কুড়া ও ছাই থাকায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালগুলো। আবার কোনো কোনো রাইসমিল দখলে নিয়েছে খালের জায়গা। সরু করে নিজেরাই নির্মাণ করে নিয়েছে কালভার্ট। দূরের রাইস মিলও পাইপ লাইনে বর্জ্যরে সংযোগ রেখেছে খালের সঙ্গে। খাজানগর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার বলেন, এলাকার কোনো পুকুরেই মাছ বাঁচে না। কদিন পরপরই মাছ মরে ভেসে ওঠে। কৃষি কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। জমিতে দূষিত পানি থাকায় ভয়ে হাত দিতে চায় না তারা। চর্ম রোগ হয়।

তিনি আরও বলেন, এসব নিয়ে মিল মালিকদের সঙ্গে স্থানীয়দের প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয়। তারা বার বার দূষিত পানি না ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মানেন না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চালকলের দূষণে টিকতে না পেরে এখন অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। বটতৈল ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান মিন্টু ফকির উদ্বেগ প্রকাশ করে ও এলাকাবাসীর ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বলেন- ছাই এবং কারখানার অন্যান্য বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মিল মালিকদের এ ব্যাপারে সদিচ্ছা না থাকায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর থেকে জানা যায় এখানকার মাত্র ৩০টি কারখানার পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি সব পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই কল-কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের কথা স্বীকার করে কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল গাফফার বলেন, খাজানগরের চাল কল মালিকদের একাধিকবার তাগাদা দেওয়ার পরও তারা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।  সরেজমিন দেখা যায় যত্রতত্র গড়ে ওঠা ধান-চাল সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো ব্যাপকভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে প্রকৃতিতে। এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন ব্যাপারী বলেন, এর আগে কল কারখানা কম ছিল, এখন বেশি হয়ে যাওয়ায় দূষণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে চালকলসহ সংশ্লিষ্ট নানা কারখানা, এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নিয়মের লাগাম না টানলে সামনের দিনগুলোতে আরও মারাত্মক পরিবেশ দূষণের শিকার হতে পারে এই এলাকার মানুষসহ জীববৈচিত্র্য। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (ফসল) বিষ্ণু পদ সাহা জানান, কল-কারখানার এসব বর্জ্যরে মধ্যে আয়রন, লেডসহ ক্ষতিকর নানা উপাদান থাকতে পারে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। আবার দূষিত পানির কারণে ফসলের উৎপাদনও কম হবে। মিল মালিকরা বলছেন, কল-কারখানার মারাত্মক পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করতে চাই না। তিনি বলেন, সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে প্লান্ট বা শোধনাগার নির্মাণ সহজ হবে। আর এটি নির্মাণ সম্ভবপর হলে এ অঞ্চলের মানুষ মারাত্মক পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

 

সর্বশেষ খবর