প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংকট, বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের অতিরিক্ত ব্যয়, বিনিয়োগের অভাব, সুদের চাপ, বিক্রিত পণ্যের টাকা বকেয়া, ভারতীয় কাপড়ের দৌরাত্ম্য, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দাপট, বাজারজাতকারণে বিঘ্নতা এমন হাজারও সমস্যা থাকলেও হুইলেই যেন বন্দী রৌমারীর সাড়ে ৫শ' তাঁতী পরিবারের জীবন। বাপ-দাদার এ পেশা না পারছেন ধরে রাখতে, না পারছেন ছেড়ে দিতে। সর্বস্বান্ত পরিবারগুলো সুদিনের অপেক্ষায় রয়েছে। চায় রৌমারীর তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। ফিরিয়ে আনতে চায় কাকডাকা ভোর থেকেই গ্রামের পর গ্রামজুড়ে তাঁতীবাড়ির খট্ খট্ শব্দ।
গত মঙ্গলবার উপজেলার নামাজেরচর, চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, ওয়াহেদ নগর, চরশৌলমারী, সাহেবের আলগা, মিয়ারচরসহ অনেক গ্রাম ঘুরে দেয়া গেছে, তাঁতীদের সব তাঁত বন্ধ। যদিও শীতের প্রস্তুতির জন্য এখন তাঁতগুলো রাত-দিন চালু থাকার কথা। তাঁতীদের চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। গোটা এলাকায় নীরবতা আর শূন্যতা। এরই মধ্যে কেউ কেউ কিছু জমি বিক্রি করে সুতার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁতগুলোতে বছরভর জমে থাকা ধুলোবালির আস্তরণ মুছে নতুন আশায় শুরু করেছেন আবার। এখানে সাধারণত শাড়ি, লুঙ্গি, শীতের চাদর ও মাফলার তৈরি করেন ওরা। ভরা শীতে একটি চাদর বিক্রি হয় ৪শ' থেকে ৪২০ টাকায়। লুঙ্গি ১০০ থেকে ৩শ' টাকায়। মাফলার ১০০ থেকে দেড়শ' টাকায়। শাড়ির বাজার তেমন ভাল নয় বলে এর কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে।
‘একদিকে তাঁতগুলো বন্ধ, অন্যদিকে শীতের শেষে ঋণদাতারা মাথার উপরে খড়্গ নিয়ে হাজির হবে। কিছুই বুঝতে চাইবে না।’ এমনটাই জানালেন নামাজেরচর এলাকার মিজান তাঁতী। তিনি বলেন, ‘ঢাকার নারায়ণগঞ্জের এক মহাজনকে ৪ লাখ টাকার চাদর বাকিতে দিছিলাম ২ বছর আগে। হ্যায় টাকা দিছে মোডে ২ লাখ। বাকি টাকা এহনতুরি পাই নাই। পরের বার দিলাম টাঙ্গাইলে। হ্যারও একই দশা। এহানকার বাজারগুলাতে এতো মাল বেচন যায় না। হ্যাশামেশা ওই বাটপারদেরই কাছে যাওন লাগে। হ্যারাও সুযোগ বুইঝা আমগোর তবিল মাইরা দেয়। এহন পুঁজির অভাবে শীতের মাল তৈরিতে হাতই দিতে পারি নাই।’ একইভাবে আবুল হোসেন নামের এক তাঁতী বলেন, এককালীন অনুদান, বিদ্যুতের সুব্যবস্থা এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত থেকে আমাদের বাঁচালে আমরা আগের মতো আবারও বাঁচিয়ে তুলতে পারবো হারিয়ে যাওয়া তাঁত শিল্পকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক পরিপত্রে ক্লাস্টার আকারে পুঁজিহীন তাঁতীদের মাঝে স্বল্প লাভে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় সকল ব্যাংক এর আওতায় পড়বে এবং বাস্তবায়ন করবে এমনটাই বলা আছে পরিপত্রে। ওই সুত্র ধরে ইতোমধ্যেই ইসলামী ব্যাংক রৌমারী শাখা ৪১ জন তাঁতীকে স্বল্প লাভে ঋণ দেয়ার ক্লাস্টার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। অবশ্য এর আগে পরীক্ষামূলক ১০ জন তাঁতীকে ৫০ হাজার করে টাকা ঋণ দিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক। এটা নিঃসন্দেহে মরু সাহারায় এক পশলা বৃষ্টির মতই প্রশান্তির বলে জানালেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক মন্ডল। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করে আসছি আমার ঐতিহ্যের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশেষে ইসলামী ব্যাংক প্রথম পর্যায়ে ৪১ জন তাঁতীকে অল্প লাভে ঋণ দিতে সম্মতি দিয়েছে এজন্য ইসলামী ব্যাংককে ধন্যবাদ।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ওই এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের তাঁত শিল্পে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে যা করা প্রয়োজন সবই করা হবে।
বিডি-প্রতিদিন/ ১০ নভেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ/১১